দেশ গঠনে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা তৃণমূলের তরুণদের শক্তিকে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড প্রদানের মাধ্যমে সকলকে সামনে এনে দিয়েছে ইয়াং বাংলা।
ষষ্ঠবারের মতো হওয়া এই আয়োজনে আজ তারুণ্যের শক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে দেশ গঠনে এগিয়ে যাওয়া বিজয়ীদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর চেয়ারপার্সন সজীব ওয়াজেদ জয়।
সিআরআই-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইয়াং বাংলার নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিগত ৮ বছরে ৬ বার দেশ গঠনে এগিয়ে আসা তরুণদের হাতে তুলে দেয়া হয় জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড।
সারাদেশ থেকে আবেদন করা দেশ গঠনে এগিয়ে আসা তরুণদের ৬০০টিরও বেশি সংগঠন থেকে যাচাই বাছাই শেষে শীর্ষ ১০ তরুণ সংগঠনের হাতে ওঠে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড। এ বছর ৫টি ক্যাটাগরির প্রতিটিতে দুটি করে ১০টি সংগঠনকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। এ ছাড়াও দেশের জন্য বিশেষ অবদান রাখায় দুই জন পেয়েছেন ‘লাইফ টাইম’ বা আজীবন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড।
এই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সিআরআই ট্রাস্টি নসরুল হামিদ বিপু।
বিজয়ী ১০ তরুণ সংগঠন ও আজীবন সম্মান পাওয়া দুইজনের মধ্যে একটি সংগঠন হচ্ছে রোবোলাইফ টেকনোলজিস। জয় বড়ুয়া লাবলু রোবোলাইফ টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও। ২০১৮ সালে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের সহযোগিতায় এ সংগঠন যাত্রা শুরু করে।
শুরুতেই তারা দুর্ঘটনা বা যে কোনো কারণে হাত হারানো ব্যক্তিদের কৃত্রিম হাত প্রতিস্থাপন করা শুরু করে। এভাবে অন্তত ২০ জনকে সহযোগিতা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তারা ৩০ হাজার টাকায় কৃত্রিম হাত প্রতিস্থাপন করছে ও এর খরচ কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরব ও তুরস্কে বেশ কিছু কৃত্রিম হাত রপ্তানিও করেছে এই প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে জয় বড়ুয়া লাবলু বলেন, আমাদের রোবোলাইফ টেকনোলজিস মূলত যে সকল মানুষের হাত নেই তাদেরকে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে হাত দেওয়া হয়। যেটার সাহায্যে ব্রেইন কন্ট্রোলের মাধ্যমে হাতটাকে পরিচালনা করতে পারবে।
বিকে স্কুল অব রিসার্চ: বিজন কুমার বিকে স্কুল অব রির্সাচের পরিচালক। সমাজ গঠন, অর্থনীতি ও মানবিকতা নিয়ে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তারা ২২ দেশের ৫৫ জন বিশেষজ্ঞ ১০০ গবেষণা সহকারী ও ৩০০ তথ্য সংগ্রাহককে নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে তারা ১০টির বেশি জার্নাল ও নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। আরও দশটি প্রকল্প নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এছাড়া শিক্ষা, পরিবেশ ও প্রযুক্তি বিষয়ে তরুণদের নিয়ে ৫টি সেমিনার ও সভা করেছে।
পুরস্কার পাওয়া আর একটি সংগঠন হচ্ছে বোসন বিজ্ঞান সংঘ। মুহাম্মদ মাজেদুর রহমান বোসন বিজ্ঞান সংঘের সভাপতি। ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞান শিখতে অনুপ্রাণিত করতে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে তারা নারীদের বিজ্ঞান এবং গণিত শিখতে অনুপ্রাণিত করতে একটি বিজ্ঞান প্রতিযোগিতার আয়োাজন করার পরিকল্পনা করছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের কাছ থেকে সেরা গণিত ক্লাব পুরস্কারে ভূষিত হয়। এছাড়াও তারা প্রাতিষ্ঠানিক, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড, জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং অলিম্পিয়াড এবং অন্যান্য পুরস্কার জিতেছে।
প্রসেনজিৎ কুমার সাহা পুরস্কার পাওয়া উচ্ছ্বাসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছে। ভোলা, বরিশাল ও ঢাকায় তাদের ৩টি কাজের স্থান রয়েছে। বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, নিম্ন আয়ের এবং বেকারদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা ও কোভিড-১৯ প্রতিক্রিয়া কার্যক্রমে “স্বপ্ন পূরণ”, “বিদ্যানিকেতন”, “জয়ী”, “স্বাবলম্বী” শিরোনামে ৩টি উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করছে। এছাড়াও তারা ৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি স্কুল চালায়। শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য যুব ও নারীর ক্ষমতায়ন।
ইয়ুথ প্ল্যানেট অন্যতম পুরস্কার পাওয়া সংগঠন । এ বি এম মাহমুদুল হাসান এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি নারীদের বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাস্থ্য ও অধিকার সম্পর্কে পুরুষদের শিক্ষিত করার বিষয়ে তারা কাজ করছে। ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রম ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় মাসিক সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সচেতনতা ৫০ভাগ পর্যন্ত বাড়াতে সাহায্য করেছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়েরর মাধ্যমে আইসিটি এবং যুব নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ, নারী উদ্যোক্তা এবং ডিজিটাল মার্কেটিং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কাজ করছে সংগঠনটি।
বিজ্ঞানপ্রিয় : মুহাম্মদ শাওন মাহমুদ বিজ্ঞানপ্রিয়’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। ২০১৭ সালে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মটির যাত্রা শুরু। দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার ছাড়াও বিজ্ঞানের অগ্রগতি, খবর, ব্লগ, ইনফোগ্রাফিক্স অডিও-ভিজ্যুয়াল সম্বলিত বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে। এছাড়াও তারা বাংলা ভাষায় একটি ডিজিটাল বিজ্ঞান অভিধান তৈরি করছে। তাদের বেশ কয়েকটি স্কুল-ভিত্তিক কার্যক্রম রয়েছে ও বিজ্ঞান প্রচারের জন্য তারা “নেবুলা” নামে একটি অনলাইন পত্রিকা প্রকাশ করে।
মজার ইশকুল এবার পুরস্কার পাওয়া অন্যতম সংগঠন। আরিয়ান আরিফ মজার ইশকুলের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। ২০১৩ সালে পথশিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত ১ হাজার সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুকে বিনামূল্যে শিক্ষা দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১০ বছর ধরে ১ হাজার সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান ও ঢাকায় ১০টি স্কুল পরিচালনা করছে তারা। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার জন্য একটি নতুন বিভাগ খোলার পরিকল্পনা করছে সংগঠনটি।
মিলন স্মৃতি পাঠাগার: আসাদুজ্জামান মিলন স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। যুব সমাজকে বই পড়ায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় মোট ১৪টি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছে। যার মধ্যে ১টি শিশু গ্রন্থাগার, ৪টি রাস্তার পাশের লাইব্রেরি এবং ৩টি রেলস্টেশন লাইব্রেরি রয়েছে। তাদের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীসহ সব বয়সের পাঠক রয়েছে। তারা পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধি ও জ্ঞান-ভিত্তিক সম্প্রদায় তৈরি করতে সহায়তা করছে।
সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন: মো. মুইনুল আহসান ফয়সাল সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র এবং আশ্রয়ের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে সংগঠনটি। ১৩ জন পূর্ণকালীন শিক্ষকের মাধ্যমে তারা বিনামূল্যে একটি স্কুল পরিচালনা করছে। ইতিমধ্যে তারা প্রায় ২ হাজার শিশুকে শিক্ষাদান করেছে। সংগঠনটি প্রতি বছর অমর একুশে বই মেলায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এবং বয়স্ক নাগরিকদের হুইলচেয়ার সরবরাহ করে। এছাড়াও নিঃস্ব নারী ও যুবকদের বৃত্তিমূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়।
বিন্দু নারী উন্নয়ন সংগঠন এবার পুরস্কার পাওয়া আরেকটি সংগঠন। জান্নাতুল মাওয়া এ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত যুব নেতৃত্বাধীন নারীবাদী সংগঠনটি জলবায়ু ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে। তারা উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বিশেষ করে নারীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৮ জন নারী নেত্রী তৈরি করেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ৩০০ মিটার বাঁধ মেরামত করার জন্য তারা সফলভাবে স্থানীয় সরকারকে রাজি করিয়েছিল।
আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন উন্মাদ-এর সম্পাদক আহসান হাবীব। দেশের আইকনিক প্রকাশনা উন্মাদ। প্রায় চার দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশের নিয়মিত এক ম্যাগাজিন এটি। প্রকাশকালে অসংখ্য রাজনৈতিক ও সমসাময়িক বিষয় ব্যতিক্রম ও ব্যাঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরে সামাজিক সমালোচনা করা হয়েছে এই ম্যাগাজিনে। ১৯৮০’র দশকে সামরিক শাসনামলে রাজনৈতিক কার্টুন প্রকাশ করায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার শিকার হন তিনি। তবুও উন্মাদের ধার কমেনি এতটুকুও। কার্টুনিস্ট হতে চাওয়া তরুণদের জন্য উন্মাদ বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন করে। বর্তমানে ম্যাগাজিনের ৫০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে।
ইয়াংগুয়াং ম্রো আজীবন সম্মাননা পাওয়া আর একজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে দূরের অন্ধকারে এক আলোকরশ্মি ইয়াংগুয়াং ম্রো। লেখালেখি ও গবেষণাই তার কাজ। তিনি ম্রো সম্প্রদায়ের ভাষায় প্রথম বই ‘টোটং’ তৈরি করেন। ম্রো ভাষার প্রথম এই কথাসাহিত্যিক ‘ম্রো ফেয়ারি টেলস’ নামে বই লিখেছেন। ২০১৩ সাল থেকে মাত্র ছয় ব্যক্তির কথ্য ভাষা ‘রেণমিতাচ্যা ভাষা’ সংরক্ষণে কাজ করছেন। নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, অর্থ ও ভিত্তিকে ছড়িয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ম্রো ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এছাড়াও ম্রো ভাষা সংরক্ষণে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে নিজের এলাকায় কুঁড়েঘর তৈরি করেছে মনে প্রাণে জুমচাষ করা এই ব্যক্তি।
মানবিক কাজ ও সমাজে অবদানের জন্য দেশের সেরা যুব সংগঠনগুলোকে স্বীকৃতি দিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’র অনুসারে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’-এর প্রবর্তন করা হয়। জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী অনেক সংগঠন ইতোমধ্যে শিশু শান্তি পুরস্কার, ডায়না অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেছে।