বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছি, কিন্তু দেশে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়নি। দেশে আজ গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার নেই। তাই বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাহিরে এই মতবিনিময়ের উদ্যোগ নিয়েছে। গত দুটি সংসদ নির্বাচনে যেভাবে ভোট ডাকাতি হয়েছে তার পর আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো ভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। দেশের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২, বিকেলে, সিলেট নগরীর একটি হোটেলের কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র মিডিয়া সেল’র উদ্যোগে ‘জবাবদিহীতামূলক রাষ্ট্র গঠনে অবাধ-নিরপেক্ষ, নির্বাচনত্তোর একটি জাতীয় সরকার এবং দ্বিকক্ষ সংসদ অপরিহার্য’ শীর্ষক মতবিনিময়সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, সকলের সম্মিলত আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে দেশে যখন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে তখন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য দেশনায়ক তারেক রহমান একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এই রূপরেখায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন হলে দেশে যেমন সুশাসন নিশ্চিত হবে তেমনি দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। এজন্য দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। জবাবদিহীতামূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। তাই আমরা একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপনের সভাপতিত্বে ও সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আক্তারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি।
মতবিনিময়সভায় বক্তব্য রাখেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট এমদাদ উল্লাহ মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম শাহীন, সুজন সিলেট চাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এমপি, ড্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ডা. শামিমুর রহমান, শাবির সাদাদল শিক্ষক পরিষদের আহবায়ক অধ্যাপক ড. সাজেদুল করিম, ইউট্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শাবির শিক্ষক প্রকৌশলী ড. মোহাম্মদ ইকবাল, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্দিকুর ইসলাম, সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এটিএম ফয়েজ, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সিলেট জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট আনসার খান, ডিইউজের সভাপতি ও মিডিয়া সেল’র সদস্য কাদের গণি চৌধুরী, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. শিব্বির আহমেদ শিবলী, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, অ্যাডভোকেট আশিক উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবুল ফজল, কবি সালেহ আহমদ খসরু।
মতবিনিময়সভার মূল বক্তব্যে মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব ও সাবেক সংসদ সদস্যশহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো ভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন যে সম্ভব নয় তা গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির মধ্যদিয়ে আজ দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর কাছে একটি সর্বজনস্বীকৃত সত্য। তাই গণআন্দোলনে ফ্যাসিবাদ পতনের পর কেবলমাত্র একটি সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রের রুটিন কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই গঠিত হতে পারে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার। জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে আজ উন্মুখ হয়ে আছে। গণমানুষের এই প্রত্যাশাকে দীর্ঘমেয়াদে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই এই অবৈধ দখলদারদের হটিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের মাঝে নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পর জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকারই আজ সময়ের দাবী। এর বাহিরে ভিন্ন প্রক্রিয়া জনগণ গ্রহণ করবে না।
তিনি আরো বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রস্তাবিত রাষ্ট্র-রূপান্তরমূলক সংষ্কারের পথনকশার আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ঘোষণা। পৃথিবীর উন্নত ও অনুসরণযোগ্য অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রচলন আছে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এমপি বলেন, একজন রাজনীতিবিদ নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেন আর একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক চিন্তা করেন আগামী ১০০ বছরে দেশ কেথায় নিয়ে যাবেন। দেশনায়ক তারেক রহমান আগামী ১০০ বছর পর দেশকে কোথায় নিয়ে যাবেন সেই চিন্তা করছেন। কিন্তু তারেক রহমানের দুর্ভাগ্য যে আওয়ামী লীগের মত একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের হাতে ১৯৭৩ সালেই গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। শহিদ জিয়া যেমন দেশকে কয়েকশত বছর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দেশনায়ক তারেক রহমানও সেই চিন্তা করছেন। গত ১০ বছরে দেশের মারাত্মকভাবে সমাজিক মূল্যবোধ হারিয়েছে। এখন রাষ্ট্র মেরামত প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি বিশ্বাস করে তাদের পক্ষে একা এ কাজটি করা সম্ভব নয়। এজন্য বিএনপি একটি জাতীয় সরকার গঠন করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হলে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ স্বচ্ছতার সাথে কাজ করতে পারবে। গত ১৩ বছরের একনায়কতন্ত্রকে ভাঙতেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ খুবই জরুরি। আগামীর রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমান দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করেছে।
ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস-ডিইউজে’র সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এদেশের মানুষকে বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধংস করে দিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে, এটা বিশ্ব স্বীকৃত। ক্ষমতা লোভী সরকার দেশকে অকার্যকর অবস্থায় নিয়ে গেছে। বাক স্বাধীনতার জন্য আইসিটি আইন এখন একটি বড় বাধা। কুইক রেন্টালকে বৈধতা দিয়ে লুটপাটকে বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এই মুহূর্তে দেশে একটি জাতীয় সরকার অপরিহার্য। দেশে আজ গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার নেই। এখন দিনের ভোট রাতে হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের দমনের আইসিটি আইনের যে বিতর্কিত ৫৭ ধারাটি করা হয়েছে দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু থাকলে তা করা সম্ভব হত না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থাসহ যে রাষ্ট্রচিন্তা করেছেন তার কোনো বিকল্প নেই।
ড্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ডা. শামিমুর রহমান বলেন, আমারা গত ১৫ বছরে দেখলাম একজন প্রধানমন্ত্রী কিভাবে স্বৈরাচারী হন, কিভাবে একজন নোবেলজয়ীকে বলেন টুস করে ফেলে দেব? দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হলে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। দেশে যে একটা চূড়ান্ত সংগ্রাম আসছে, সেখানে যারা অংশগ্রহণ করবেন তাদের নিয়ে বিএনপি যে জাতীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করেছে তা বিএনপির উদারতা। দেশের যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে তার জন্য এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় সরকার অপরিহার্য।
শাবির সাদা দল শিক্ষক পরিষদের আহবায়ক অধ্যাপক ড. সাজেদুল করিম বলেন, একটি উন্নত দেশের চেহারা কেমন হতে পারে প্রাথমিক ধারণা আজকের সূচনা বক্তব্যে দেয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গত ২৮শে মার্চ জাতির সামনে দেশকে নিয়ে যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ তো হবে নির্বাচনের পরে। কিন্তু এই মুহূর্তে দেশে কিভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। তারেক রহমান সুস্পষ্ট বলেছেন, বিএনপি নির্বাচিত হলে যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন নির্বাচনে তারা জয়ী হন বা না হন সবাইকে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এটি অত্যন্ত বড় মনের পরিচয়।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট এমদাদ উল্লাহ মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, দেশের সংবিধানের এক কেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে রেখেই আমরা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট যে সংসদ ব্যবস্থা করতে চাচ্ছেন। ভারতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা চালু করলেও তারা তা পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। সিলেটের ৫টি মহকুমা ছিল এর মধ্যে দেশ ভাগের সময় আমাদের একটি মহকুমা ভারতে চলে গেল। ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন হলো। সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন করে দেয়া হলো। কিন্তু আজকে বিচার বিভাগ কোন অবস্থায় আছে? নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কোন কিছুই প্রফার কাজ করছে না। ক্ষমতা হস্তান্তর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করারই এখন প্রধান জাতীয় সংকট।
সুজন, সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কেন দাবী আদায় করতে হলে সংগঠিত ও স্বোচ্ছার জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন। দাবী আদায় করতে হলে বিএনপির স্পিড বাড়াতে হবে। সোনিয়া গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন কিন্তু মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। আমাদেরকে পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। চারজন মেয়রকে যখন মর্যাদা দেয়া হলো, তখন আমি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এর প্রতিবাদ করেছি। এসব বিষয় নিয়ে আপনাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বার বার শপথ ভঙ্গ করেছেন, এটি খুবই দুঃখজনক।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্দিকুর ইসলাম, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের কনসেপ্টটি আজ নতুন কিছু নয়। ১৯৪৩ সালে ভারতবর্ষে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতীয় সরকার গঠিত হয়েছিল। জাতীয় সংকট মোকাবেলা করার জন্যই জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা আসে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতে এটি এখন খুবই অপরিহার্য।
এসময় উপিস্থিত ছিলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও ড. এনামুল হক চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, সিলেট মহানগর বিএনপির আহবায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালি পংকী, সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী, সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মিফতাহ্ সিদ্দিকী, সিলেট জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমদসহ প্রমূখ।