তিমির বনিক,মৌলভীবাজার থেকে: মনিপুরের সংস্কৃতির নানা বৈচিত্র্যের অন্যতম হলো মণিপুরিদের নববর্ষ উৎসব ‘চৈরাউবা কুম্মৈ’। মণিপুরিদের নিজস্ব বর্ষগণনা পদ্ধতি রয়েছে, সেই বর্ষগণনা থেকেই নববর্ষ উদ্যাপন করে আসছেন তাঁরা। গত শনিবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরে মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্সে মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি নববর্ষ (চৈরাউবা কুম্মৈ) ৩৪২০ উদ্বোধন করা হয়। আনুষ্ঠানিকতা চলবে লাগাদার ৫দিন। শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয়। তার পর খেলাধুলা ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাচে-গানে দিনব্যাপী উৎসব পালন করা হয়।
মণিপুরিদের তৎকালীন রাজা মোরিয়া ফমবালচা এই বর্ষগণনার পদ্ধতি চালু করেন। মণিপুরি সন গণনার হিসাব অনুযায়ী বারো মাসের নাম হলো শজিবু, কালেন, ইঙা, ইঙেন, থরান, লাংবন, মেরা, হিয়াঙ্গৈ, পোইনু, রাকচিং, ফাইরেন ও লমতা।
অনুষ্ঠানে মণিপুরি সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি এ কে শেরাম, মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্সের আহ্বায়ক এল জয়ন্ত কুমার সিংহ, মণিপুরি জাদুঘরের পরিচালক হামোম তনুবাবু, ইমা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান কবি খোইরম ইন্দ্রজিৎ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধন শেষে মণিপুরি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। শোভাযাত্রাটি মণিপুরিপাড়ার বিভিন্ন অংশ প্রদক্ষিণ করে কালচারাল কমপ্লেক্সে শেষ হয়। এরপর সৃষ্টিকর্তার প্রতি সন্তুষ্টি কামনা করে এবং করোনামুক্ত পৃথিবী ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বন দেবতার পূজা করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে শুরু হয় বয়স্ক নারীদের অংশগ্রহণে লেখন খেলা বা কড়ি খেলা, কাং খেলা, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বিকেলে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
আলোচনা সভায় দুজন অতিথিকে সম্মাননা ক্রেস্ট ও উত্তরীয় দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন খেলা ও প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মণিপুরি শিল্পীরা নৃত্য উপস্থাপন করেন। এরপর শুরু হয় সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাবল চোংবা। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে এ নৃত্য চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। পাঁচ শতাধিক অবিবাহিত মণিপুরি তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণে নাচ চলে কয়েক ঘণ্টা বর্ষবরণ উৎসবকে মনমুগ্ধকর করে তুলে পুরো অনুষ্ঠানটিকতায়।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, মণিপুরিদের নিজস্ব একটি বর্ষগণনা রীতি রয়েছে। ‘মালিয়াকুম’ নামের এই চান্দ্রবর্ষের হিসাবে ৩৪২০তম বর্ষ ২ এপ্রিল শুরু হলো। অন্যান্য বছরের মতো এবারও এই দিন মণিপুরি নববর্ষ উৎসব ‘চৈরাউবা কুম্মৈ ৩৪২০’ উদ্যাপনের লক্ষ্যে কমলগঞ্জে মণিপুরিপাড়ার প্রতিটি ঘরে আনন্দ ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। উৎসবের আগের রাত জেগে মণিপুরি যুবক যুবতীরা কড়ি খেলে হাসি আনন্দে কাটায়। মণিপুরি লোকবিশ্বাসে এই রাতকে বলা হয় ভাগ্য রজনী। এই রাতেই দেবতারা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। উৎসবের পরের পাঁচ দিন তাঁরা খেলাধুলা করে হাসি আনন্দে কাটান বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মণিপুরিরা আসে এ উৎসবে যোগ দিতে।
উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি সনাতন হামোম বলেন, মণিপুরিদেরও নিজস্ব নববর্ষ রয়েছে তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী। আমাদের এ উৎসব করার উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্ম এর সঙ্গে যুক্ত হবে। পুরনো ঐতিহ্য নতুনদের মধ্যে যেন বিরাজমান থাকে। এর মধ্য দিয়ে মণিপুরি নববর্ষ, ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে তারা কাজ করবে আগামীর প্রজম্মের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।