জিয়াউল হক জুমনঃ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করতে প্রস্তুতির প্রয়োজন, অনেক গবেষণা এবং একই সাথে বিজ্ঞানীদের প্রনোদনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, “বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেশে বড় রকমের উম্ফলন ঘটে যাচ্ছে যাকে ধারণ করতে হবে, অবগাহন করতে হবে এবং আমাদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে।“ গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিকে তিনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সোনালী যুগ বলে অবিহিত করেন।
তিনি আরও বলেন, “দেশের কৃষি খাতে আজকের যে বিপ্লব তার ভিত্তিটা বঙ্গবন্ধুই করে দিয়েছিলেন। গবেষণা ছাড়া একটা দেশ প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। ব্যপক গবেষণা না করলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে আমরা ধারণ করতে পারবো না। “ প্রায়োগিক গবেষণা করে দেশের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে তিনি বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। দেশের কল্যাণের জন্য ইনস্টিটিউট অব ন্যানোটেকনোলজি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, “ন্যানোটেকনোলজির উপযোগিতা প্রচুর, বিজ্ঞানীদের ভুমিকা রাখার অবকাশ প্রচুর, ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি না আনা পর্যন্ত, স্টেইট অব দ্যা আর্টস টেকনোলজি ধারণ না করা পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। “ গত শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর ২০২১) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ন্যানো সোসাইটি (বিএনএস) কর্তৃক আয়োজিত “বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভাবনা” শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
উক্ত ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও ঢাকাস্থ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন এর সম্মানিত পরিচালক ড. সেঁজুতি সাহা। তিনি বলেন, “ন্যানোটেকনোলজি জিনিসটা হয়তোবা ছোট, ব্যপারটা কিন্ত বড়। “ ফাইজারের ভ্যাকসিন তৈরিতে ন্যানোটেকনোলজির বিশাল ভুমিকা কথা তিনি উল্লেখ করেন। আইনের ছাত্র হয়েও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ এবং অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়কে তার সময়ে বিশ্ব বিরল ঘটনা বলে সেঁজুতি সাহা মনে করেন। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলতেন, বিজ্ঞান গবেষণায়ই শক্তি। শিক্ষার সাথে গবেষণার একটা বন্ধন গড়তেই হবে। বিজ্ঞানী না হয়েও বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানীদের চেয়েও বেশি উপলব্ধি করেছেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের তরুণেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে দেশে ফিরে এসে দেশের কল্যাণে যাতে কাজ করতে পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই তথকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করেন। বঙ্গবন্ধু তখনকার সময়েই টেকসই উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন এবং সে মোতাবেক কাজ করতেন। বিশেষত কৃষিতে তার গৃহীত অনেকগুলো পদুক্ষেপের কারণেই আমরা বর্তমানে খাদ্যে স্বনির্ভর। “ অল্প কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধু যা করেছেন আরও অনেকদিন বেঁচে থাকলে তিনি আরও অনেক কিছু করতেন বলে আক্ষেপ করেন ড. সেঁজুতি সাহা। তিনি আরও বলেন, “২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবেলায় জিনোম সিক্যেন্সিং, পিসিআর টেস্ট সহ বিভিন্ন কাজে তরুণরা যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিলো সেটা তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মতোই দেশের জন্য একটা যুদ্ধ ছিলো। বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান চেতনাকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। “ বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান ভাবনার সাথে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সময়ে ঘটে যাওয়া বাস্তবত অভিজ্ঞতা তিনি তার আলোচনায় সবিস্তারে তুলে ধরেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণার প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে আলাদা একটা অগ্রাধিকার ছিলো তার উদাহরণ হিসাবে বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব্ববিদ্যালয়কে রাজনীতির বাইরে রাখার প্রসংগ উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞানীদের রাজনীতি থেকে দূরে রেখে বিজ্ঞান ও গবেষণায় মনোযোগী হয়ে দেশের গরীব মানুষের কল্যাণে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কৃষিতে সার, কীটনাশক, রোগবালাই সারানো ইত্যাদি কাজে ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহারের মাধ্যেম কৃষকের উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে আনা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রধান, প্রফেসর ড. তফাজ্জল ইসলাম তার বক্তব্যে ন্যানোটেকনোলজি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জাতীয় অর্থনীতিতে ন্যানোটেকনোলজির অবদান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “ন্যানোটেকনোলজি বিলিয়ন ডলারের বিজনেস। আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেক প্রতিভাবান গবেষক আছেন যারা তাদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ন্যানোটেকনোলহি গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারেন। তিনি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ ন্যানোটেকনোলজি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করার আহবান জানান। ২০১৮ সালে জাতীয় কৃষি নীতিতে ন্যানোটেকনোলজির অন্তর্ভুক্তির ফলে ইতোমধ্যেই অনেক সুফল পাওয়া গেছে। ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি হিসাবে ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্টে প্রোডাক্ট তৈরির ক্ষেত্রে আমরা ন্যানোটেকনোলজিকে নিয়ে যেতে চাই। ব্লু ইকোনমির মতো ন্যানোটেকনোলজি নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারলে আমরা দেশে এবং বিদেশে কৃষি, চিকিতসা, ইলেক্ট্রনিক্স এর মতো বিভিন্ন সেক্টরে সফল হতে পারবো। “ তিনি ন্যানোটেকনোলজি ও তার ব্যবহার সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং জাতীয় পরিকল্পনায় ন্যানোটেকনোলজিকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ন্যানোটেকনোলজি কর্মশালার কথা স্মরণ করে আলোচনা সভার সভাপতি ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. আল-নকীব চৌধুরী বলেন, “প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার বা এধরণের প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণার যে আগ্রহ এবং চিন্তাভাবনা তিনি সম্প্রতি লক্ষ্য করেছেন তাকে কাজে লাগাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা আরও সহজ হবে। আর এক্ষেত্রে ন্যাশনাল ন্যানোটেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন, জাতীয় গবেষণা নীতিমালায় ন্যানোটেকনোলজির অন্তর্ভুক্তি দেশে প্রযুক্তি বিকাশে, সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তিনি বাংলাদেশ ন্যানো সোসাইটির ভিশন ও মিশন সভায় তুলে ধরেন। পাশাপাশি উন্নয়নে ন্যানোটেকনোলজির ভুমিকা সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেন।