
মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত। খালেছ অন্তরে মানুষ যখনই যেভাবে ডাকে আল্লাহ পাক সে ডাকে তখনি সাড়া দেন। রিয়া ও নফস হতে মুক্ত হলেই এবাদত কামিয়াবির পর্যায়ে পৌঁছে। এবাদতকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম নিয়ামক হলো খুলুছিয়ত তথা বিশুদ্ধ নিয়ত। প্রিয় রাসুল (দ.)-এর সমস্ত কর্মকা- এখলাসের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। খলিফায়ে রাসুল হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম (রা.) এখলাসের সুরভিত সৌন্দর্যের অলংকারে সমগ্র জীবনকে নবী প্রেমে রাঙিয়েছেন। পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন । আঁধারে আলোকবর্তিকা হয়ে জ¦লে উঠেছেন নূরে মোস্তফার ঐশী আহ্বানে। গাউছিয়্যতের কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, “আমাদের তরিক্বত হচ্ছে এছলাহে বাতেনী অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি, তরিক্বতপন্থিদের নিয়ত খালেছ না হলে এ পথে উন্নতির আশা বৃথা”। ফলশ্রুতিতে তিনি আল্লাহ ও রাসুল (দ.)-এর নিকট এতটাই প্রিয় হয়েছেন যে খলিলুল্লাহ ও খলিফায়ে রাসুল (দ.)-এর মর্যাদা অর্জন করেছেন। তাইতো খুলুছিয়ত প্রতিষ্ঠায় কালশ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি খলিফায়ে রাসুল হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু।
গত সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদস্থ গাউছুল আজম সিটিতে দিন-রাতব্যাপী অনুষ্ঠিত ৬৯তম পবিত্র মিরাজুন্নবী (দ.) উদ্যাপন ও কাগতিয়া দরবারের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুল্লাহ, আওলাদে মোস্তফা, খলিফায়ে রাসূল (দ.) হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর স্মরণে অনুষ্ঠিত ঈছালে ছাওয়াব মাহফিলে এই মহামনীষীর একমাত্র খলিফা, মোর্শেদে আজম হযরতুলহাজ্ব আল্লামা অধ্যক্ষ শায়খ ছৈয়্যদ মুহাম্মদ মুনির উল্লাহ্ আহমদী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, খলিফায়ে রাসুল হযরত গাউছুল আজম (রা.) তাঁর সমস্ত জীবন আল্লাহ ও রাসুল (দ.)-এর সন্তুষ্টির নিরিখে পরিচালিত করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের জীবনকে এবাদত ও এখলাসের উপর সাজানোর জন্য তরিক্বতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। এখলাসকে মানুষের অন্তরে নবীপ্রেমের আলো দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার খোদায়ী রূপরেখা দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর চাকচিক্যের ভিতরে থেকেও লক্ষ লক্ষ যুবক এই মহান তরিক্বতে অর্ন্তভুক্ত হয়ে এখলাসের সাথে জীবন যাপন করছে। তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল, শোকর ও সবর এর অনুশীলন, সুন্নাতে রাসুল (দ.) জীবনে ধারণ, দরূদ শরীফ-মোরাকাবা-ফয়েজে কুরআন-তাহাজ্জুদ-জিকিরে জলী ও জিকিরে খফির অনুশীলন, নূরে মুহাম্মদী (দ.) ক্বলবে নিয়ে আখেরাতমুখী হওয়া, আল্লাহ ও রাসুল (দ.)-এর বেঁধে দেওয়া জীবনবিধানকেই চূড়ান্ত হিসেবে মেনে এই সমস্ত বিষয়বস্তুকে মনে-প্রাণে ধারণ করে জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য তরিক্বতকে সৃষ্টির সামনে তুলে ধরেছেন । গামারি, মেহগনি, পাতাবাহার, বরবটি গাছের পাতায় খোদায়ীভাবে এই তরিক্বতের মনোগ্রাম অঙ্কিত হওয়ার মাধ্যমে কবুল হওয়ার প্রমাণ দৃশ্যমান।
খলিফায়ে রাসুল হযরত গাউছুল আজম (রা.)-এর পবিত্র বেছাল শরীফ পবিত্র মিরাজুন্নবী (দ.)-এর বরকতময় সময়ে। এ উপলক্ষ্যে প্রতিবছর ওরছে পাক অনুষ্ঠিত হয়। শরীয়তসম্মত এমন ওরছ শরীফ ধরার বুকে বিরল। একচুল পরিমাণও শরীয়তের লঙ্ঘন ্্এখানে নেই, নেই কোনোকিছু আনার রেওয়াজ; এখানে আসতে হয় একমাত্র খুলুছিয়ত নিয়ে। সমস্ত জীবন যিনি খুলুছিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য কেঁদেছেন, উনার ওরছে পাকে খুলুছিয়ত নিয়ে আসতে পারাই একমাত্র উপহার। মহান এই ওরছে পাক উপলক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওরছে পাক উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে বাণী প্রদান করেছেন। এছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এম.পি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এম.পি, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এম.পি বাণী প্রদান করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শারীরিক শিক্ষা বিভাগ এর চেয়ারম্যান ও সিনেট সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সালানা ওরছে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগ এর দপ্তর সম্পাদক আলহাজ্ব মোহাম্মদ নূর খাঁন, প্রফেসর ড. জালাল আহমদ, হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মোহাম্মদ ইসহাক মুনিরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ¦ সরোয়ার কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান।
এদিন ফজরের নামাজের পর খতম শরীফ, মোরাকাবা, ঈছালে ছাওয়াব, মিলাদ-কিয়াম ও মুনাজাতের পর খতমে কুরআন অদায়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ওরছের কর্মসূচি। পূর্ব ষোষিত তারিখ থেকে মহিলা, প্রবাসী, তরিক্বতপন্থী ও উপস্থিত মুসলিম জনতা সর্বমোট ১৬১২৭ টি খতমে কোরআন ২০৫৭ টি খতমে তাহলীল এবং ১৫৭ টি খতমে ইউনুচ আদায় করেন। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও কাগতিয়া দরবার থেকে পূর্বেই ঘোষতি হয়েছিল-ওরছে কারোর কাছ থেকে গরু-মহিষ-ছাগল, টাকা-পয়সা, নজর-নেওয়াজ ইত্যাদি নেওয়া হবে না, চলবে না শরীয়ত পরিপন্থী কোনো কার্যকলাপ, শুধু কোরআন-সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণে পালিত হবে এ মহামনীষীর সালানা ওরছ। অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে সুমধুর সুরে কুরআন তিলাওয়াত, তাহলিল ও নিম্নস্বরে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ জিকির এবং নবী (দ.)-এর শানে দরূদ পাঠ। এ যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, প্রশান্তিময় পরিবেশ। শুধু দেশের নয়, সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশে আসা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-মধ্যপ্রাচ্য, সৌদিআরব, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কাগতিয়া দরবারের শত শত অনুসারী এতে অংশ নেয়। বিদেশে অবস্থানরত এ মনীষীর অনুসারীরাও বাদ পড়েননি, তারাও এদিন স্বস্ব স্থানে বসে আর মহিলারা নিজেদের ঘরে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকেন।
সালানা ওরছে যোগদানের উদ্দেশ্যে সকাল থেকেই চট্টগ্রামের আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ডু, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, পটিয়া ছাড়াও রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, মহেশখালী থেকে গাড়িযোগে কাগতিয়া দরবারের অসংখ্য অনুসারী, ভক্ত ও সাধারণ মুসলমানেরা সালানা ওরছে আসতে থাকে। চট্টগ্রাম ছাড়া ফেনী, কুমিল্লা,বি.বাড়িয়া, চাঁদপুর ও ঢাকা থেকেও কাগতিয়া দরবারের হাজার হাজার অনুসারী ও মুসলমানেরা উপস্থিত হন। সালানা ওরছে যোগদানের জন্য শুধু দেশের নয়, বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সৌদিআরবসহ ওমান, কাতার, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবী, শারজাহ্ হতেও কাগতিয়া দরবারের অনুসারীরা সপ্তাহখানেক পূর্ব থেকে বাংলাদেশে আসেতে থাকেন। সালানা ওরছ উপলক্ষ্যে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আলোকসজ্জিত করা হয় । মাগরিবের আগেই গাউছুল আজম কমপ্লে¬ক্সের বিশাল ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে জনসমুদ্রে রূপ নেয়।
পরিশেষে মিলাদ কিয়াম, প্রিয় রাসুল (দ.) ও খলিফায়ে রাসুল হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম (রা.)-এর খুলছিয়তের ওসিলায় দেশ জাতির কল্যাণ, উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি এবং হযরত গাউছুল আজম (রা.)-এর ফুয়ুজাত কামনা করে মোনাজাতের মাধ্যমে এখলাসময় এবাদতের মহাকর্মযজ্ঞ সমাপ্ত হয়।