বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনের আবেদন করেছে তার পরিবার। আবেদনে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো শর্তারোপ না করারও অনুরোধ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে পরিবারের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার এ আবেদন করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবেদনটির আইনগত দিক পর্যালোচনা করতে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেরণ করেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, জামিনের সময়, বিদেশে যাওয়া এবং শর্তারোপের বিষয় নিয়ে বর্তমানে খালেদা জিয়ার পরিবার ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে পর্দার আড়ালে আলোচনা চলছে। জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে ইতিবাচক হলেও লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে সরকারি মহল। খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন পাওয়ার কথা স্বীকার করে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আবেদনটির আইনগত দিক পর্যালোচনা করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইনি দিক বিচার বিশ্নেষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সূত্র জানিয়েছে, আইন মন্ত্রণালয় সরকারের উচ্চ মহলের ‘গ্রিন সিগন্যাল’-এর অপেক্ষায় রয়েছে। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছয় মাসের জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। অবশ্য এ নিয়ে পর্দার আড়ালে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্য ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সরকারের উচ্চ মহলের কথাবার্তা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কয়েক দফা গোপন বৈঠকও করেছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, খালেদা জিয়া বিদেশে গেলেও চিকিৎসার বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারবেন না বলে সরকারের পক্ষ থেকে শর্তারোপ করা হচ্ছে। তবে বিএনপি বিনাশর্তে তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চায়। সরকার চায়, বিশেষ করে লন্ডনে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া যাবে না। সভা-সমাবেশে যোগদান থেকে বিরত থাকতে হবে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বিদেশিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্য এসব শর্ত মেনে খালেদা জিয়া লন্ডন যেতে রাজি হচ্ছেন না।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার পরিবারের ওপর নির্ভর করবে সব কিছু। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও উন্নত চিকিৎসার ব্যাপারটি বিবেচনা করে তার পরিবার কিছু শর্ত মেনেও নিতে পারে বলে সূত্র বলছে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেনদরবার করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, চলমান করোনা পরিস্থিতি, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থাসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামিনের ব্যাপারে সরকারি মহল ‘ইতিবাচক’ আভাস দিয়েছে। জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারি মহল নমনীয় হলেও লন্ডনে যাওয়ার ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে যে শর্তারোপ করা হয়েছে, এবার স্থায়ী জামিন বা মেয়াদ বৃদ্ধির আদেশে তা না রাখার জন্য বিএনপি জোর চেষ্টা করছে। এমনকি দেশি-বিদেশিদের মাধ্যমেও লবিং-তদবির করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল সমকালকে বলেছেন, জামিনের আবেদনের বিষয়টি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে দেখা হচ্ছে। তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া প্রয়োজন। যেখানে দেশের মানুষ মৌলিক চিকিৎসাই পাচ্ছেন না, সেখানে তার চিকিৎসা কীভাবে হবে? খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনের দাবি জানাই। আশা করি সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে স্থায়ী এবং শর্তহীন জামিন মঞ্জুর করতে ভূমিকা রাখবে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন সমকালকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এ পর্যন্ত জামিনের কোনো শর্তই ভঙ্গ করেননি। তারা আশা করেন, জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরকার তাকে আবারও জামিনের ব্যবস্থা করবে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকার খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসায় লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি দিলে দ্রুত ভিসাসহ সার্বিক ব্যাপারে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহযোগিতা আগেই চেয়ে রেখেছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আন্তর্জাতিক উইংয়ের অন্যতম সদস্য তাবিথ আউয়াল ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকশনের সঙ্গে দূতাবাসে বৈঠক করেন। বৈঠকে খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি এবং লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে ব্রিটেনের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন বিএনপি মহাসচিব।
মামলায় সাজা হওয়ার পর থেকেই খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন। কিন্তু আইনি লড়াই ও রাজপথের আন্দোলন ব্যর্থ হলে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে নির্বাহী আদেশে জামিন দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে গত ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলা বিচারের পর্যায়ে আছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা ভোগ করছেন খালেদা জিয়া। দুই মামলায় তার ১৭ বছরের সাজা হয়েছে। ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস এবং চোখ ও আর্থ্রাইটিস সমস্যায় ভুগছেন।
উৎসঃ দৈনিক সমকাল