
তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের খেতে সবুজ রঙের গালিচায় মোড়ানো খেতে বাতাসে দুলছে বোরো ধানের। সম্প্রতি এমনটাই দেখা মিললো।
গেল মৌসুমে বন্যার কারণে এসব মাঠ থেকে আমন ধান ঘরে তুলতে পারেননি হাওরপারের কৃষকেরা। বোরো চাষে আমনের সেই ক্ষতি হয়তো পূরণ হবে না। তবু ঘুরে দাঁড়াতে কৃষকের সব মনোযোগ এই মাঠের দিকেই। কৃষকদের কেউ সেই জমিতে আগাছা পরিষ্কার করছেন, কেউ পোকা দমনে ওষুধ স্প্রে করছেন। কেউ খেতে ছিটিয়ে দিচ্ছেন সার। কেউ দিচ্ছেন সেচ। চলছে ধানখেতের নানামুখী পরিচর্যা।
কাউয়াদীঘি হাওরপারজুড়ে এখন যত দূর চোখ যায়, সবুজের বিস্তৃতি। এই সবুজ সম্প্রতি রোপণ করা বোরো ফসলের। মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তীর্ণ কাউয়াদীঘি হাওর ও হাওরপারের সব দিকেই স্থির, শান্ত সবুজভূমি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। মাথা তুলে দাঁড়ানো বোরো ধানের গোছা মৃদু বাতাসে দুলছে। হাওরের দিগন্তজুড়ে চোখজুড়ানো ধুধু সবুজ প্রকৃতি, আর কিছু নেই।
সম্প্রতি সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের একাটুনা ও আখাইলকুড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন মাঠে এরই মধ্যে সবুজ হয়ে উঠেছে বোরো ধানের চারা। হাওরে যাওয়ার পথে চোখে পড়েছে কিছু গ্রামের বাড়ির আশপাশে দু–এক টুকরা জমিতে হালি চারা রোপণ করা হচ্ছে, দু–একটি স্থানে রোপণের জন্য চারা তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় মাঠেই চারা রোপণের কাজ পৌষের শেষ ও মাঘের শুরুতে শেষ হয়ে গেছে।
হাওরের বিরাইমাবাদসহ কয়েকটি মাঠে দেখা গেছে, ধানের চারা শুধু মাথা তুলেই দাঁড়ায়নি, ধানের গোছা সবল হয়ে গাছ গুলো বাতাসে দুলছে। কোনো খেতে কৃষক আগাছা পরিষ্কার করছেন, কোনো খেতে আগাছা ও পোকা দমনে ওষুধের স্প্রে করা হচ্ছে। অনেক কৃষক দুপুরবেলায় খেত দেখতে এদিক ওদিক বেরিয়ে দেখছেন। এ রকম সকাল-বিকাল অনেকেই খেতে পানি ঠিকঠাক মতো আছে কি না, খেতে পোকার আক্রমণ হয়েছে কি না, এসব ঘুরে ঘুরে দেখছেন। বিরাইমাবাদ এলাকা থেকে হাওরপার ও হাওরের যত দূর চোখ যায়, তত দূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সবুজ রঙে বোরো ধানের দুল খাচ্ছে।
দুপুরে খেতের আগাছা পরিষ্কার করে বাড়ি ফেরার পথে বিরাইমাবাদের ইসরাইল মিয়া বলেন, ‘মাঘ মাসের প্রথম দিকেই চারা রোয়ার (রোপণ) কাজ শেষ অই (হয়ে) গেছে। এখন মাঝেমাঝে কিছু পোকার আক্রমণ আছে। এ ছাড়া আর সমস্যা দেখছি না। এখন ঘাস বাছরাম (আগাছা বাছাই করা হচ্ছে)। ধান তো ভালাই অর দেখরাম (হচ্ছে দেখছি)।’ তিনি জানান, তিনি ৩২ কিয়ার (১ কিয়ার=৩০ শতাংশ) জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। এখন আগাছা পরিষ্কারের কাজ চলছে। আগাছা পরিষ্কার করাতে একজন শ্রমিককে রোজ ৬০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিকিয়ার পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তাঁর। তিনি ব্রি-২৯ ও ৮৯ জাতের বোরো ধান চাষ করেছেন।
হাওরের একটি এলাকার খেতে কীটনাশক স্প্রে করছিলেন মো. জাহাঙ্গীর। স্প্রে শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ধানের রং সুন্দর আছে। ধান দেখতে ভালা আছে। তবে কিছু জমিতে পোকা ধরছে। ওষুধ দিলাম, যাতে ধান নষ্ট করতে না পারে। ১৪ কিয়ার জমি চাষ করছিলাম। দুবার সার দেওয়ার পর ধান পানিয়ে নষ্ট করছে। জানে মারি লাইছে (প্রাণে মেরে ফেলেছে)।’ তিনি জানান, ১৩ কিয়ার জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। তবে বোরো ফসল দিয়ে আমনের ক্ষতি পোষানো কঠিন হবে বলে মনে করেন।
বোরো চাষ করে আমন ধানের ক্ষতি পোষানো কঠিন বলে মনে করেন পাড়াশিমইল গ্রামের রনি আহমদ মিজু। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘সময়মতো পানির অভাবে দেরিতে ধান রোপণ করতে হয়েছে আমাদের। তবে এখন আমাদের রোপণ শেষ। এবার আমাদের এলাকার (পাড়াশিমইল) কেউ আমন ধান পায়নি। বন্যার পানিতে সব তলিয়ে গিয়েছিল। এখন বোরো ফসলই একমাত্র ভরসা। কিন্তু বোরো ফসল দিয়ে আমনের ক্ষতি পোষানো যাবে না জানি। সারের দাম বাড়ছে, ওষুধের দাম বাড়ছে। আমরা কৃষকেরা সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মৌলভীবাজারে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬২ হাজার ১০০ হেক্টর। এর মধ্যে কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে মনু সেচ প্রকল্পে আছে ১০ হাজার হেক্টর।
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি আলমগীর হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, সদর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন একাটুনা ও আখাইলকুড়ার কৃষকেরা আমন চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই এবছর গত বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণে বোরো চাষাবাদে আগ্রহ হয়েছে। তবে কৃষকদের মধ্যে শঙ্কার ছাড়া রয়ে গিয়েছে। বৈশাখ মাসে ধান পাকার সময় বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে অনেক কৃষকের ধান তলিয়ে যায় এতে করে সর্বশান্ত হয়ে গেছে অনেক কৃষক। ওই সময় মনু সেচ প্রকল্পের কাশিমপুর পাম্প হাউস যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে কৃষকেরা ঘরে ধান তুলতে পারবেন। সদর উপজেলার খোজারগাঁও, গল্লা, বুড়িকোনা, বিরাইমাবাদ, কালাইউড়া, খৈসাউড়া, রসুলপুর, রায়পুর, বানেশ্রী, পাড়াশিমইল, সানন্দপুর, কান্দিগাঁও, জগৎপুর, জুমাপুর, কাদিপুর, মিরপুর, পালপুর, কচুয়া, একাটুনা, বড়কাপন, উলুয়াইল, লালাপুরসহ হাওরপারের ভিন্ন ভিন্ন মাঠে বোরোর আবাদ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হাওরের দিকে আবাদ প্রায় শেষ। সারাজেলায় এরই মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি আবাদ হয়ে গেছে। মনু সেচ প্রকল্পের আওতায় কাউয়াদীঘি হাওরের সবটাই আবাদ হবে। এখন উপরের দিকে কিছু খেতে রোপণ বাকি আছে। খেতে কিছু পোকার আক্রমণ আছে, তবে তা পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে আরও কম হবে।’