করোনায় মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে ‘৪০ গুণ’ বেশি বলে দাবি করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৪৯ জনের, আক্রান্ত ২৩ হাজার ৮৭০ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা আরও ৪০ গুণ বেশি হবে। গণমাধ্যমের তথ্যমতে করোনা উপসর্গে এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১১০০ জন।’
মঙ্গলবার (১৯ মে) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত ‘জাতীয় করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সেল’-এর সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এসব তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় তার সঙ্গে সেলের আহ্বায়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও বক্তব্য দেন। টুকু বলেন, ‘আমরা যে হিসাব দিয়েছি, তা বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের যে চিত্র, সরকার যে তা গোপন করছে— তার একটি ব্যাখ্যা আমরা দিয়েছি।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রায় সোয়া দুই মাস আগে বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্তের পর সরকারের সমন্বয়হীনতা ও উদাসীনতায় এখন প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।’
ফখরুল জানান, করোনায় এ পর্যন্ত ডাক্তার ৭৮০ জন, নার্স ৬০০ ও স্বাস্থ্যকর্মী ৫৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে পাঁচ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২শ’র অধিক, অন্যান্য বাহিনীর আরও ৬ শতাধিক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ১৫ জন। গণমাধ্যমকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৩৫ জন। তিন জন মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রশাসনেরও বেশ কিছু সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন। করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের প্রতি গভীর শোক ও তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করেন, মানুষের জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। যখন চীনে করোনা মহামারি শুরু হলো তখন সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। তখন তারা অন্য একটি অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। প্রথম থেকে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিলে আজ লাশের সারি দীর্ঘ হতো না। জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহি না থাকার কারণে সরকার এমন আচরণ করেছে। মানুষকে বাঁচাতে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকার ঘোষিত ৪২টি টেস্ট সেন্টারের বেশ কয়েকটি সেন্টার কার্যকর নয়। যেসব সেন্টারে টেস্ট হচ্ছে তাও অপর্যাপ্ত। মানুষ লাইন ধরে ফিরে যাচ্ছেন টেস্ট না করে। আপনারা গণমাধ্যমে দেখেছেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালের সামনের সড়কে কী লম্বা লাইন। আগের রাতে লাইন ধরে অসুস্থ রোগীরা কীভাবে শুয়ে আছেন, বসে আছেন। তারপরও টেস্টের সিরিয়াল পাচ্ছেন না। অন্যান্য হাসপাতালেও একই অবস্থা।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে পরিমাণ টেস্ট হচ্ছে তাও আবার এখনও পর্যন্ত দিনে ১০ হাজারে ওঠেনি। এরমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ শতাংশ উঠেছে। যদি বেশি টেস্ট হতো তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বেড়ে যেতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে— টেস্ট টেস্ট টেস্ট। টেস্টের কোনও বিকল্প নেই। যত বেশি টেস্ট করা হবে, তত বেশি সংক্রমিত জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো সম্ভব হবে।’
লকডাউন শিথিল করে সরকার দেশকে ‘ভয়ংকর বিপজ্জনক’ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ফখরুল। তিনি বলেন, ‘ডিএমপি থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে দোকান খুলে দেওয়া হলো, রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া হলো। এটা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের সঙ্গে। যে কনসেপ্ট যে চিন্তা, সেটার সঙ্গে এই দোকান খুলে দেওয়াটা সাংঘাতিকভাবে একেবারে সাংঘর্ষিক। গতকাল (সোমবার) সংবাদপত্রে এসেছে, পুরনো ঢাকায় কীসের সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং? হাজার-লাখো মানুষ সব রাস্তায় নেমে গেছে। আমাদের তো জানার কথা যে এটা হবে।’
করোনায় মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে দাবি করে ফখরুল বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে করোনা মোকাবিলা দূরে থাক, সারা দেশ ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে লকডাউন শিথিল ও যথাযথ তদারকি না করে ভয়ংকর বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে দেশকে। দাম্ভিকতা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা, সমন্বয়হীনতা, উদাসীনতা ও একগুঁয়েমি মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করেন, যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে কীভাবে সরকারি টাকা লুট হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা অপ্রতুল। দেশের ৯০ ভাগ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থাও নেই। এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়নি।’
বিরোধী দল ও মতের প্রতি চরম অবজ্ঞার কারণে সরকার সর্বদলীয় উদ্যোগ নেয়নি অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের ডেকে পরামর্শ নিতে পারতো। নেয়নি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের সম্পৃক্ত না করে দলীয়করণ করা হচ্ছে। আজ যদি সর্বদলীয় ঐক্য হতো, তাহলে ত্রাণের নামে দেশজুড়ে যে লুটপাট হচ্ছে তা হতো না।’
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখলাম ৫০ লাখ কর্মহীন লোকের মাঝে ১২শ’ ৫৭ কোটি টাকা বিতরণ করছে সরকার। মোবাইলে বিকাশের মাধ্যমে, ব্যাংকের মাধ্যমে সে টাকা বিতরণ হবে। সেখানেও নগদ টাকা লুট হচ্ছে। একজনের মোবাইল নম্বরে ৩০৬ জনের নাম। অর্থাৎ ৩০৬ জনের টাকা একজন লুট করবে।’
বিএনপি মহাসচিব জানান, তার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৩১ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৩টি পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে বিএনপি। এই ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি সারা দেশে অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, ‘ড্যাব ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে প্রায় ৭৫টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ইমারজেন্সি বিভাগে প্রায় ২ হাজার পূর্ণাঙ্গ পিপিই সরবরাহ করেছে। সেই সঙ্গে অনলাইনের মাধ্যমে ড্যাব সদস্যরা দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা প্রদান করছেন।’
ফখরুল অভিযোগ করেন, করোনার এই ভয়াবহ দুর্যোগেও সরকারের নিপীড়ন থেমে নেই। সরকারি ত্রাণের অনিয়ম, চাল চুরি ও করোনা নিয়ে সমালোচনা করায় এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গণমাধ্যমকর্মীসহ ৪১১ জনকে গ্রেফতার করেছে সরকার। তিনি ডিজিটাল আইন বাতিলের দাবি করেন।
সংবাদ সম্মেলনে করোনা জাতীয় পর্যবেক্ষণ সেলের আহ্বায়ক ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা যে সেলটা করেছি, সেটা একেবারে ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত কাজ শুরু করেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন বিভাগ ও বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা রিপোর্ট পাচ্ছি যে ইউনিয়ন লেভেলে কী অবস্থা মানুষের। রক্ত পরীক্ষা কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে হচ্ছে না। জাতি হিসেবে আমরা এ দেশের মানুষ একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আর যারা রক্ত পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের রিপোর্টও পাওয়া যায় না। যেমন, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ সাহেব ১০ দিন আগে রক্ত দিয়েছেন। উনি ডাক্তার, উনার রিপোর্ট উনি এখনও পান নাই। তাহলে সাধারণ মানুষদের কী অবস্থা হবে। সরকার কোনও আইনি ব্যবস্থা না দিয়ে মানুষকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করে নাই— একমাত্র কারণ যে, তাদের খাবার দিতে পারবে না।’
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সেলের সমন্বয়ক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন নসু, সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান উপস্থিত ছিলেন।