লন্ডনে একজন ব্যারিস্টার হিসেবে মোটামুটি ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছিলাম। প্রায় দু’মাস আগের কথা- দুই মিলিয়ন লন্ডন অধিবাসীর মতই সকাল বেলার ব্যস্ত মূহুর্তের বৈতরণী পেরিয়ে গণপরিবহনে চড়ে শহরের আনাচে-কানাচে অবস্থিত বিভিন্ন আদালতে উপস্থিত হচ্ছিলাম। কভিড- ১৯ এর লকডাউনে কিন্তু আমাকে ঘরেই অবস্থান করতে হচ্ছে। বয়স যখন সত্তরের ঘরে, আমাকে মোটামুটি ঝুঁকিপূর্ণ বয়সেরই ধরা হয়। বাইরের জগতের সাথে আমার যতটুকু যোগাযোগ তা হলো শুধু পড়ার রুমের জানালা দিয়ে দেখা বসন্তের সূর্য কিরণে পার্কে শারীরিক কসরত করতে যাওয়া কিছু ব্যক্তি, মা-বাবার সাথে হেঁটে যাওয়া কিছু শিশু-কিশোর। কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত একমাত্র বিনোদন এটিই। যে লন্ডন শহর ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক হতেই আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু তা আজ যেন এক ভূতের শহর।
২০২০ সাল কভিড- ১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীর বছর, যে বছরে চীনের একটি আর্দ্র বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটি পুরোবিশ্বকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিয়েছে। এ বছরটি সেভাবেই স্মরণ করা হবে যেভাবে স্মরণ করা হয় ৫০ মিলিয়ন লোকের হন্তারক স্প্যানিশ ফ্লুর ১৯১৮- ১৯২০ সময়কাল কিংবা ১৬৬৫-৬৬ সময়কাল যখন প্রকান্ত প্লেগের মহামারী লন্ডনের ১৫% মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল, অথবা ১৩৪৬- ১৩৫৩ এর ভয়াবহ সময়কাল যখন black death নামক মহামড়ক এশিয়া থেকে ধেয়ে এসে ইউরোপের অর্ধেকের ও বেশি জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন করেছিল।
উন্নত বিশ্বের খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই আঁচ করতে পেরেছিল যে সাধারণ সর্দি ঠান্ডার মতই মনে হওয়া একটি ভাইরাস হাজার হাজার মৃত্যু ঘটাতে পারে। তথাপি এ অদৃশ্য ও নির্বিষ মনে হওয়া শত্রুটি আমাদের গ্রহে ক্ষতির ঝঞ্ঝা বইয়ে দিয়েছে।
কে রাজা কে প্রজা, কে ধনী কে গরীব কিংবা কারা সাদা কারা কালো তা কভিড- ১৯ এর কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, একাধিক হলিউড তারকা, সুয়েটোর বস্তিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী এবং ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরে হতদরিদ্র বাসিন্দাদের শরীরে সংক্রমণ ঘটিয়েছে এ কভিড- ১৯ ভাইরাসটি। বিশ্বব্যাপী পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে। মানসিক চাপ-উদ্বেগ ও বিষণতার মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। অনির্দিষ্টকালের এই বন্দী দশার ভারে নুয়েপড়া শ্রেণীর মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এসকল ঘটনা আমাদেরকে আল-কুরআনের বাণী যেমন ‘মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে’ (৪ঃ২৮) ‘তাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র পারস্পারিক পরিচয়ের সুবিধার জন্যই’ (৪৯ঃ১৩) এর কথা মনে করিয়ে দেয়। সমাজে আমাদের জাতীয়তা কিংবা অবস্থান যাই হোক না আমরা সবাই এই ভাইরাসের শিকার হতে পারি। ভৌগলিক সীমারেখা কিংবা ধন-সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। আমাদের সকলেরই একই অবস্থান – সমান দুর্দশায় ঐক্যবদ্ধ। সমাজ আমাদের আলাদা আলাদা কিস্তু সম্মিলিত ভাবে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে মোকাবেলা করছি।
চলমান এই সময়ে সকল ধমের্র অনুসারীরাই একই সংকট মোকাবেলা করছেন। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর এবারের ঈস্টার সানডে ভাষণ রেখেছেন জনমানব শূন্য সেন্ট পিটার্স ব্যাসেলিকতে। যা সাধারণত হাজার হাজার ক্যাথলিকদের উপচে পড়া সমাবেশে হয়ে থাকে। ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ এবারের ঈস্টার সানডে ভাষণ দিয়েছেন তার রান্নাঘর থেকেই। আর মুসলমানদের জন্য পবিত্র মাস রমাদানেও পবিত্র দুটি মসজিদ মক্কা ও মদিনায় সাধারণ মুসল্লিদের প্রবেশাধিকার স্থগিত ছিল। এত সব বিশৃংখলা সত্ত্বেও চলমান সংকটটি আমাদের সবাইকে একত্রিত করেছে। এপ্রিলের নিস্তব্ধ এক অপরাহ্নে ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দু জার্মানির ডুইসবার্গ শহরে মুসলমানদের প্রার্থনার আহ্বান- আযানের আওয়াজ শ্রুত হয়েছে। কভিড- ১৯ পূর্ববর্তী সময়ে জার্মানির কোন শহরে আযানের আওয়াজ কে মনে করা হতো অবোধগম্য। মূলত ২০১৮ সালের ফেব্রয়ারির দিকে জার্মানির এক প্রশাসনিক আদালতের আদেশে একটি মসজিদে আযান প্রচার বন্ধ করা হয়। মনে হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠী ও মানবতার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আরোপিত সব প্রতিবন্ধকতা রাতারাতিই বিদুরিত হল, বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যগুলো বিতাড়িত হচ্ছে। সহমর্মিতা ও ঐক্যের পথ রচিত হচ্ছে।
পোপ বৈশ্বিক এ মহামারী মোকাবেলার জন্য পুরো বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। ইংল্যান্ডের গীর্জা সমূহের প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২২ মার্চ হাজার হাজার খৃস্টান ধর্মাবলম্বী একই সাথে প্রার্থনায় যোগ দিয়েছেন। ইহুদি ধর্মগুরুদের একটি জোট খোলা চিঠিতে ইহুদি সংগঠনগুলোকে “পুরো মানব জাতি ও পরস্পরের কল্যাণের জন্য” প্রার্থনার উপর জোর দিয়েছেন। সারা বিশ্বের মুসলমানগন কঠিন দুঃসময়ে আল্লাহর রহমতের জন্য দোয়া করে যাচ্ছেন। তাওরাত, বাইবেল ও কোরআন মূলতঃ একই রকম আহ্বান জানিয়েছেন – প্রতিকূলতার সময়ে তোমরা প্রভুর দিকে ফিরে যাও। বিশ্ব মহামারীর এ কঠিন সময়ে বৃটেনের রানী বললেন– “সকল ধমের্র বহু অনুসারী এবং ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন লোকজন আজ এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন যে এ সময়টি প্রার্থনা ও ধ্যানে নিমগ্ন হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে”।
একাকিত্বের সময়টাতে নীরব ধ্যান অন্যের আবেগ অনুভূতির সাথে একাত্ম হতে পারার সক্ষমতা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ এনে দেয়। লকডাউনে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লকডাউনে থাকা যেমন গাজায় দুই মিলিয়ন ফিলিস্তিনি জনগণ, বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত ক্যাম্পে গুলোতে বসবাসরত ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, তুবস্কের উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসরত প্রায় চার মিলিয়ন সিরিয়াবাসী, চীনের এক মিলিয়নেরও বেশি উইঘুর নৃগোষ্ঠীএবং ভারতের কাশ্মীরের ১২ মিলিয়নের ও বেশি জনগোষ্ঠীর অবস্থা অনুধাবনে বাধ্য করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘসময় থেকে মানবতার বিরুদ্ধে এ সমস্ত অমানবিক আচরণের জবাবে খুবই দায়সারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে। মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণাপত্রে বিধৃত হয়েছে “সকল মানুষ মর্যাদাও অধিকারে সমান” এবং “কারো প্রতি অমর্যাদাকর ব্যবহার করা যাবে না”। তথাপি ঘোষণাপত্রটি প্রণীত হওয়ার পর ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও সকল মানুষের প্রতি সম-ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি অথবা অমর্যাদাকর ব্যবহার থেকে মানবতাকে সুরক্ষাও দেওয়া হয়নি। কভিড- ১৯ উত্তর বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সম্মিলিত ভাবে পুরো মানবগোষ্ঠীকেই লকডাউন অবস্থা থেকে উদ্ধারে তৎপর হওয়া। কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব-জনস্বাস্থ্য বিষয়ের একজন অধ্যাপক অনুমান করেছিলেন যে চীনে কোন প্রাণীর দেহ থেকে এক প্রকারের ভাইরাস নির্গত হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি একটি অদৃশ্যশত্রু। “ভূপৃষ্ঠ ও নভোমন্ডলের সকল শক্তি আল্লাহরই’’ (কোরআন ৪৮ঃ ৭) এবং “আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ সে সম্পর্কে অবহিত নন” (কোরআন ৭৪ঃ ৩১) । কোন একপর্যায়ে সম্ভবত আমরা জানতে পারবো যে মানুষের অপকমের্র ফলেই ভাইরাসটির জন্ম ।
কভিড- ১৯ সৃষ্ঠরোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধ হয়তো পাওয়া যাবে, প্রতিষেধকও হয়তো আবিষ্কার হবে। তবে এখন চলুন পুরো মানবজাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দূর্যোগ মোকাবেলা করি। বৈশ্বিক এ মহামারী কেটে গেলে প্রতিটি রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে এবং সঙ্গত কারনেই বিধ্বস্থ নিজ নিজ অর্থনীতি পুর্নগঠনের এর দিকে মনোযোগ দেবে। অনেকের ধারণা কভিড- ১৯ উত্তর দুনিয়া ৯/১১ উত্তর দুনিয়ার মত হবে না। কিন্তু বর্ণ, বিশ্বাস নির্বিশেষে নিষ্পেষিত মানবতার [মুসতাদাফিন, কোরআন ৪ঃ৭৫] কষ্ট অনুধাবনের যে শিক্ষা লকডাউন আমাদের দিয়ে যাচ্ছে তা যেন না ভুলি। যেভাবে অসাধারণ এক পরিস্থিতিতে অভূতপূর্ব ভাবে ডুইসবার্গের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে এসেছিল সেভাবেই কভিড – ১৯ হোক দূর্বল ও নিষ্পেষিত মানবতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলার ঘণ্টা ধ্বনি।
লেখক: পেশায় সক্রিয় ইংল্যান্ডের একজন ব্যারিস্টার।