ইরানের ১৩তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসিকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ড. মোহসেন রেজায়ীর চেয়ে এক কোটি ৫৫ লাখ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। শনিবার ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুর রেজা রাহমানি ফাজলি এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন।
আব্দুর রেজা রাহমানি ফাজলি জানান, এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি ৯৩ লাখ ১০ হাজার ৩০৭। ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন দুই কোটি ৮৯ লাখ তিন হাজার ৩০৪ জন। এর মধ্যে ইব্রাহিম রায়িসি পেয়েছেন এক কোটি ৭৯ লাখ ২৬ হাজার ৩৪৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোহসেন রেজায়ী পেয়েছেন ৩৪ লাখ ১২ হাজার ৭১২ ভোট। অপর দুই প্রার্থী আব্দুন নাসের হেম্মাতি ২৪ লাখ ২৭ হাজার ২০১ এবং সাইয়্যেদ আমির হোসেইন কাজিজাদেহ পেয়েছেন ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭১৮ ভোট।
নির্বাচনে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইব্রাহিম রায়িসি পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোহসেন রেজায়ী পেয়েছেন ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। আব্দুন নাসের হেম্মাতি পেয়েছেন ৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং কাজিজাদেহ হাশেমি পেয়েছেন ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই বেসরকারিভাবে এগিয়ে থাকায় সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসিকে অভিনন্দন জানান তার তিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ পর্যন্ত ইব্রাহিম রায়িসি ২০১৯ সাল থেকে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। আগামী আগস্টে দেশটির ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন তিনি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের কঠোর বাছাই প্রক্রিয়ায় অনেককেই বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের মতো রক্ষণশীল প্রার্থীও দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি। বস্তুত এবারের নির্বাচনে সংস্কারবাদী শিবিরের শক্তিশালী কোনও প্রার্থী ছিল না। ফলে ইস্টাবলিশমেন্টের পছন্দের প্রার্থী রায়িসি-র বিজয় অনেকটাই অনুমিত ছিল।
বিবিসি জানিয়েছে, অতি রক্ষণশীল রায়িসি-র ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং অতীতে রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গেও তার সম্পর্ক রয়েছে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি হবেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ইরানের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে প্রেসিডেন্টের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
৬০ বছর বয়সী ইব্রাহিম রায়িসি তার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি হাসান রুহানির কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হন। ইব্রাহিম রায়িসি দেখিয়েছেন যে, ইরানে দুর্নীতি মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে তিনিই হবেন সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তবে ১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের যেভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাতে তার ভূমিকা নিয়ে বহু ইরানি এবং মানবাধিকার কর্মী উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। ইরান কখনও ওই গণমৃত্যুদণ্ডের কথা স্বীকার করেনি। এতে রায়িসি-র ভূমিকা নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তিনি কখনও কোনও মন্তব্য করেননি।
ইরান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর রায়িসি-র জয়ের তাৎপর্য
বিবিসি-র ফার্সি বিভাগের কাসরা নাজি বলছেন, রায়িসি-র অধীনে কট্টরপন্থীরা ইসলামি অনুশাসন মেনে সরকার পরিচালনার ব্যাপারে আরও কঠোর হবে। যার অর্থ সামাজিক কার্যক্রমের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ, নারীদের কর্মসংস্থান ও স্বাধীনতা কমে যাওয়া এবং সংবাদ মাধ্যমসহ সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ।
কট্টরপন্থীরা পশ্চিমাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করলেও ইব্রাহিম রায়িসি এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি; উভয়েই পরমাণু কর্মসূচির বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ফিরে যেতে আগ্রহী বলে ধারণা করা হয়। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করার শর্তে দেশটির ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। তার প্রশাসন ইরানের ওপর বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞার ফলে সাধারণ ইরানিরা অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়ে। এতে করে দেশটির সাধারণ মানুষের মনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় চালু করে। চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ভিয়েনায় আলোচনা চলছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও চুক্তিটি টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী। কিন্তু উভয় পক্ষই বলছে, অন্য পক্ষকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। সূত্র: পার্স টুডে, বিবিসি, ডিডাব্লিউ, আল জাজিরা।