এক : পচাত্তরে সামরিক অভূত্থানে বাকশালের পতনের পর বাকশাল বিরোধী আ,লীগ নেতা খন্দকার মোশতাকের হাতে শাসন ক্ষামতা আসার পরই শুরু হয় বিভিন্ন রকমের ঘটনা এবং দূর্ঘটনা। একদিকে ভারতপন্থী সামরিক অফিসার খালেদ মোশারফের বাকশালের লেজিটিমেসি নিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা অন্যদিকে কর্নেল তাহেরের ” বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ” দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে সেনাবাহিনীর ভিতরে চরম নৈরাজ্য এবং দেশের শাসন ক্ষমতা নিয়ে উদ্ভট ও অবাস্তব কর্মসূচীর কারনে তৎকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হয়ে গিয়েছিল ভয়াবহ নাজুক।
সেই তীব্র সংকটকালীন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় ৭ নভেম্বরের ১৯৭৬ সালে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আবিভূত হয়েছিলেন বাংলাদেশের রাখাল রাজা হয়ে। সাধারণ জনগন এবং সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকেরা ” নারায়ে তকবীর, আল্লাহ আকবর ” এবং বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে শ্লোগান দিয়ে কারাগার থেকে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসেন। ক্ষমতার স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের রাহুগ্রাস থেকে বের করে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বহুদলীয় গনতন্ত্রের সিড়ি বেয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে সার্বভৌমত্বের “অক্ষ রেখায় ” ফিরিয়ে এনেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া জেনারেল মঞ্জু নেতৃত্বাধীন কতিপয় বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে পা রাখেন বেগম খালেদা জিয়া। সমালোচকদের দৃষ্টিতে বিএনপি নামক রাজনৈতিক ক্লাবকে ক্রমানয়ে রাজনৈতিক দলে পরিনত করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেন বেগম জিয়া তার আপোষহীন মনোভাব এবং পরিশীলিত ব্যাক্তিত্ব দিয়ে।
দুই. এরশাদের পতনের পর ভোট-ব্যালট এবং জামায়াতের সমর্থনে একানব্বইয়ে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেগম জিয়া সরকারের আসেন। গনতান্ত্রিক পথে প্রথমবার দেশ শাসনের সুযোগ পাওয়ার পর খালেদা জিয়া ক্ষমতার শেষ মেয়াদে এসে অগনতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় ঠিকে যাবার চেষ্টা করেন। তবে তিনি শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিবাদের বিমূর্ত প্রতীক না হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই
গণমানুষের ভাষা বুঝতে পেরে দ্রুতই তত্তাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গনতন্ত্রের সিদ্ধ পথে আবারো ফিরে আসেন।
পচানব্বই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এই রাজনৈতিক শঠতা বাংলাদেশে ভারতপন্থী রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতা কাছাকাছি আনতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। ক্ষমতায় ঠিকে থাকার জন্য বাকা পথ অবলম্বননের কারনে তৎকালীন বিএনপি সরকারকে সমর্থন দেওয়া জামায়াতও বাধ্য হয়েছিলো বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে। পরবর্তীতে, জামায়াতের ল্যাবরোটারিতে আবিস্কার হওয়া তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আ,লীগ যুগপৎ আআন্দোলন শুরু করে জামায়াতের হাত ধরেই।
পচানব্বই সালে বিএনপির ক্ষমতায় ঠিক থাকবার জন্য ভোট-ব্যালটকে পাশ কাঠানোর চেষ্টার কারনেই তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জামায়াত- আ,লীগের কঠোর যুগপৎ আন্দোলন অনিবার্য নিয়তি হয়ে গিয়েছিল।
তিন. বর্তমান বাস্তবতায় এসে আজকে পরিস্কার হয়ে গেছে সেদিনকার আন্দোলনের কারনে ভারতপন্থী রাজনৈতিক শক্তি কিভাবে এবং কতো দ্রুত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো। অনকে ঘটনার পালাবদলে এসে দুই হাজার এক সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। পশ্চিমা বিশ্বের “ওয়ার অন টেররে ” সেই যুগে আ,লীগের জঙ্গিবিরোধী অতি প্রচার এবং অপপ্রচার, বিএনপি সরকারের কতিপয় মন্ত্রীদের দূর্নীর্তি এবং বিরোধী রাজনৈতিক শিবির দ্বারা দূর্নীর্তির খতিয়ান প্রোপ্রাগান্ডা আকারে প্রচার, মিডিয়ার সঙ্গে অতি -দূরুত্ব। সর্বোপরি তারেক জিয়ার কিছুটা বাড়াবাড়ি এবং তা নিয়ে অতিরঞ্জিত প্রচার এবং অপপ্রচার এসব অনেক কিছুই সেদিন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সূর্যকে অস্তমিত করেছিলো!
চার. এরপর নানা ঘটনা পরিক্রমায় ” ওয়ার অন টেররে ” ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর দাড়িয়ে আমেরিকা -ভারতের পরকীয়ায় জন্ম হয় ওয়ান ইলেভেন সরকারের। সেই সময় থেকেই মূলত বাংলাদেশকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। ওয়ান ইলেভেন সরকারের তৈরী করা লাল কার্পেটের উপর দিয়েই দুই হাজার নয় সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে আ,লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এখন প্রর্যন্ত অনেক জল গড়য়িছে। দুই হাজার চৌদ্দ এবং দুই হাজার আঠারো সালের এর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বুকে বসা ফ্যাসিবাদ এখন পুরো পরিণত।
এই পরিনত ফ্যাসিবাদের মেরুদণ্ডে হঠাৎ করেই এখন ক্ষয়ের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
পাচ. পুরো ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গিয়েছে রাশিয়ার -ইউক্রেন যুদ্বকে কেন্দ্র করে।কারন, মার্কিন যুক্তারাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যেকার মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে গিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। সেটা ভিন্ন এবং বড় এক আলোচনা।
পরিবর্তিত এই প্রেক্ষপটে আমেরিকা এখন বাংলাদেশকে তার নিজস্ব চোখ দিয়েই দেখছে, ভারতের চোখ দিয়ে নয়। র্যাবের উপর মার্কিন স্যাংশন এবং গনতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে চোখে পড়ার মতো পশ্চিমা শক্তিসূমহের বিভিন্ন ধরনের কাজ ও কথাবার্তা কিছু দিন ধরে লক্ষ্যে করা যাচ্ছে। সর্বশেষ ছয় ডিসেম্বরে পশ্চিমা শক্তি সূমহের যৌথ বিবৃতি সেই দৃষ্টিভংগিকেই ইঙ্গিত করে!
ছয়. ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বিএনপি এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ত্যাগ এবং কৌশলের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী এই কঠিন চুড়ান্ত রাজনৈতিক যুদ্ধে আপাতত শুরটা বিএনপিকেই করতে হবে। কারন, বিএনপির প্রধানতম রাজনৈতিক মিত্র এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি জামায়াত ২০১৩-২০১৪ সালে টগবগে তারুণ্যের উপর ভর করে নিজেদের শক্ত-সামর্থ্যর সবটুকু দিয়েই সারা দেশে গণআন্দোলনের কঠিন দুর্ঘ গড়ে তুলেছিলো। দুঃখজনকভাবে, সেই আন্দোলনে বিএনপি অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা ; রাজনৈতিক বৈধতা প্রর্যন্ত দেয় নি। সেই সুযোগে ফ্যাসিষ্ট রেজিম ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্টুরতমভাবে জামায়াতকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে দমন করেছিলো। এখন অঘোষিতভাবেই জামায়াতের নূন্যতম মৌলিক মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারকে একাবারেই নাই করেই দেওয়া হয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিক নতুন এই সমীকরণের সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে এবার দাড়াতেই হবে। সামনে থেকে বিএনপি একবার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া উচু করলেই সকল গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি রাজপথে নেমে যাবে। এই বার বিএনপি ব্যর্থ হলে ;ব্যর্থ হয়ে যাবে পুরো বাংলাদেশ। তবে, ইতিহাস বলে ব্যাক্তি, গোষ্ঠী এবং শাসকদের পাপ এবং নিষ্টুরতা যখন পরিপূর্ণ হয়ে যায় ; তখন সেই জালিমদের ধ্বংসের গহ্বরে পড়া সময়ের ব্যাপার হয়ে যায় মাত্র। বাংলাদেশে সম্ভবত এখন ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষনে দাড়িয়ে!
লেখকঃ তানভীর আহমদ তোহা
সাবেক প্রভাষক এবং কলামিষ্ট