মোহাম্মদ মিলন আকতার, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধিঃ ১৯৭১সালের ২৫ শে মার্চ হতে রাত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের উপর অতর্কিত আক্রমন করে। লক্ষ্য একটাই দামে রাখতে চাই বাঙালি জাতিকে কিন্তু বাঙালি জাতি কারো কাছে মাথা নত করবার নয় । শুরু হয় যুদ্ধ।তারই ধারাবাহিকতায় ঠাকুরগাঁও জেলায় পাকিস্তানের দোসররা আক্রমণের ছক কষে।
মুক্তিকামী বাঙালিরা কৌশলে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। বাঙ্গালীদের প্রতিরোধে পাকিস্তানি আর্মি অনেকটাই দিশাহারা। এদেশের দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি আর্মি রাণীশংকৈলে ক্যাম্প নির্মাণ করে । প্রতিদিন বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জ থেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লোকদের ধরে আনা হতো আর্মি ক্যাম্পে ।নির্মাণ করা হয় টর্চার সেলও। সেখানে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার পরে লাশগুলোকে খুনিয়া দিঘি তে ফেলে দেওয়া হতো। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করার জন্য রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডাঃ আব্দুর রহমান ও তার সহোদর কে খুনিয়া দিঘিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। কথিত আছে প্রায় ২০০ বছরেরও আগে স্থানীয় কোন এক জমিদার ৬ একর জমিতে এই দিঘি খনন করেছিল । জনশ্রুতি আছে, এলাকায় ব্যবসায়ীরা দিঘির পাশ দিয়ে ব্যবসা করতে যেতেন রায়গঞ্জে। দিঘির এলাকাটি নির্জন ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। এখানে কে বা কাহারা এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দিঘির পাড়ে ফেলে রেখেছিল এ থেকে এ দিঘি নামকরণ করা হয় খুনিয়া দিঘি ।বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের দোসরদের দ্বারা দুই থেকে তিন হাজার মানুষকে খুনিয়া দিঘি তে হত্যা করা হয় । এর ফলে মানুষের রক্তে দিঘির পানির রং হয়ে যায় ঘন খয়েরি।
দিঘির পাড়ের শিমুল গাছে মুক্তিযুদ্ধাদের হাতের তালুতে লোহার পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করত । কখনো কখনো হত্যার পূর্বে লোকজনকে কবর খুঁড়তে বাধ্য করতো । হত্যার পরে দিঘির পাড়ের উঁচু জমিতে মাটি চাপা দিত।স্বাধীনতার পরবর্তীতে অনেক দেশ প্রেমিক মানুষের কঙ্কাল, মাথার খুনি, দেহের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায় । দেশের অন্যতম বৃহৎ বদ্ধভূমি হিসেবে খুনিয়া দিঘি স্থান করে নেয় কান্নাভরা ইতিহাসের পাতায় । মানুষের আর্তনাদ, আহাজারি, রক্ত, লাশ, কঙ্কালে ভরপুর খুনিয়া দিঘি নামটি আরো ইতিহাসে সার্থক হয়ে ওঠে। শহীদদের স্মরণে জাতীয় চার নেতার মধ্যে অন্যতম আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ১৯৭৩ সালে এখানে স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন । এখনো খুনিয়া দিঘির বধ্যভূমির উপরে লাল সূর্য প্রতিনিয়তই ডুবে । দিঘির পাশে একটা বড় শিমুল গাছ আজও দাঁড়িয়ে আছে । বসন্তের বাতাসে আজও গুটিকয়েক রক্তিম লাল শিমুল ফুল এসে পড়ে খুনিয়া দিঘির স্মৃতিসৌধের বেদীতে । মনে করে দেয় আজও বীরদের রক্তের কথা । প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চে মানুষজন ফুল দিতে আসলেও বছরে আর খবর নেয় না কেউ । খুনিয়া দিঘির পাশে এখন একটি বেদি তৈরি হলেও দেখার যেন কেউ নেই। দখলদারিত্ব, অবহেলা আর অযত্নে কেমন আছে ঘুমন্ত বীর ত্যাগী সন্তানরা ? স্থানীয়দের দাবি কালের ক্রমান্বয়ে যেন হারিয়ে না যায় এই মহান স্বাধীনতার সূর্য সন্তানদের ইতিহাস । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যেন অমর হয়ে থাকে তার জন্য এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা অতি অপরিহার্য ।