মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির (৪০) একজন ভুয়া চিকিৎসক। শুধু তাই নয় একজন প্রতারক, ভন্ড। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে শুধু অসুস্থ মানুষের সাথে প্রতারণা করে ক্ষান্ত হননি তিনি। প্রতারণা করে বিয়ে করেছেন স্বাস্থ্যখাতের একজন উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে। বুধবার ভ্রাম্যমান আদালত ওই ভুয়া চিকিৎসককে কারাদণ্ড দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজারের চকরিয়ার বেসরকারি জমজম হাসপাতালে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে মেডিসিনের কনসালটেন্ট হিসেবে রোগী দেখে আসছেন মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস) নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমুর বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছিলেন। কিন্তু তার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে স্থানীয় চিকিৎসকদের মধ্যে সন্দেহ ছিলো আগে থেকেই। কিন্তু কথাবার্তা, চালচলনে বেশ স্মার্ট ছিলেন বলে কেউ সাহস করেন নি। তার ওপর বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তাকে সব রকমের সহায়তা দিত।
বুধবার (১৬ নভেম্বর) সকালে উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেস্ট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাত উজ জামানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জমজম হাসপাতাল থেকে তাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তিনি এতটাই কৌশলী ছিলেন যে ভ্রাম্যমাণ আদালতও ভড়কে যায়। পরে স্থানীয় চিকিৎসকরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনের আসল চিকিৎসক হুমায়ুন কবীর হিমুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার ভুয়ার বিষয়টির সত্যতা মেলে।
সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার টরকীচর টরকী ইসলামপুর এলাকার দিদারুল আলমের ছেলে। অথচ বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনের আসল চিকিৎসককের বাড়ী গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে।
অভিযোগ আছে আটকৃত হুমায়ুন কবিরকে জমজম হাসপাতালের ২০১৯-২০-/২০-২১ অর্থ বছরের হাসপাতালে লাইন্সেস নবায়ন করার জন্য তাকে বিশেষজ্ঞ ডা: দেখিয়ে অনলাইন আবেদন করে।
চকরিয়া স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শোভন দত্তের কাছে আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমজম হাসপাতাল থেকে হুমায়ুন কবির নামের ভুয়া চিকিৎসক দীর্ঘ ৫ বছর ধরে জাল সনদ দিয়ে চাকরি করে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। সাধারণ রোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সনদ যাচাই করার জন্য হাসপাতাল থেকে একজন ডা: নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেস্টের সাথে পাঠানো হয়। তারা যাচাই করে দেখতে পায় তার ডাক্তারি সনদ জাল। আটককৃত ভুয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক জমজম হাসপাতালে বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেস্ট মো: রাহাত উজ জামান বলেন, অভিযুক্ত হুমায়ুন কবির মূলত একজন ভুয়া চিকিৎসক। তার সকল ডিগ্রি ভুয়া। তিনি বিষয়টি গোপন করে একই নামের অপর এক চিকিৎসকের (হুমায়ুন কবির সরকার) কাগজপত্র জালিয়াতি করে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে চকরিয়া জমজম হাসপাতালে কর্মরত থেকে চিকিৎসা নামে প্রতারণা করে আসছিল।
এ ব্যাপারে নিনসের নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককের নাম ব্যবহার করে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করা অন্যায়। আমি মনে করি তার সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জড়িত। আমি ভুয়া চিকিৎসকের কঠোর শাস্তির পাশাপাশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের শাস্তিও কামনা করি। এ ব্যক্তি কিছুদিন পর কারাগার থেকে বের হয়ে অন্য কোন জায়গায় মানুষকে প্রতারিত করতে পারে। তাই সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে তুহিন তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছরের ১৪ আগস্ট আমার আব্বার করোনা শনাক্ত হয়। আমরা এ ভুয়া ডাক্তারকে অনেক বিশ্বাস করতাম। ওর কথার ওপর ভিত্তি করে জমজম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে শুরু করি। প্রথম দুদিন রোগীর অবস্থা ভলো ছিল। আমি আর আমার ভাইয়েরা ওর কাছে বারবার জানতে চেয়েছি ওই হাসপাতালে এরকম রোগীর চিকিৎসা আছে কি না। ও কনফিডেন্টলি বলল কিছু হবে না। এরপর থেকে আব্বা অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন।
তিনি বলেন, চারদিন পর সন্ধ্যা ৬টায় রুটির ট্রিটমেন্ট দেয়ার পর আব্বার প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। ওই ডাক্তারকে বিয়টা জানালে সে কোনরোপ কর্ণপাত না করে ১.৫ – ২ ঘন্টা পর এসে জানায় তাদের চিকিৎসা শেষ। আমরা সবাই হতভম্ব!! আমরা তখন আব্বাকে কক্সাবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। ইমাজেন্সি ডাক্তার I C U রেফার করে। পরদিন সকাল ৯টায় আব্বা মারা যান। এরপর থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো ডাক্তারকে বিশ্বাস করি না। আমি এ ভুয়া চিকিৎসকের ফাঁসি চাই।