প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের মৃত্যুতে তার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে আগামীকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ অর্ধদিবস বন্ধ রাখা হবে। আজ রোববার বিকেলে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে খন্দকার মাহবুবের জানাজা শুরুর আগে এ ঘোষণা দেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির চারবারের সভাপতি ও বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আগামীকাল কোর্টের দ্বিতীয়ার্ধে (দুপুর ১টার পর) বিচারকাজ বন্ধ থাকবে। এদিকে হাজারও আইনজীবী ও বিচারপতির অংশগ্রহণে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ৬০ বছরের প্রিয় কর্মস্থল থেকে তাকে অশ্রুজলে চিরবিদায় জানান সহকর্মীরা।
রোববার বেলা ৩টা ২০ মিনিটে চতুর্থ দফায় অনুষ্ঠিত এই জানাজায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীসহ আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। হুইল চেয়ারে করে জানাজায় অংশগ্রহণ করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জানাজা শেষে প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মরহুমের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
খন্দকার মাহবু হোসেনের জুনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, রোববার সকালে বসুন্ধরার ছাপড়া মসজিদে প্রথম দফায় জানাজা হয়। দ্বিতীয় দফায় জানায় হয় মিরপুর খন্দকার মাহবুব হোসেন চক্ষু হাসপাতালে। তিৃতীয় দফায় জানাজা হয় নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে। এরপর চতুর্থ দফায় সুপ্রিমকোর্টে তার প্রিয় কর্মস্থলে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি জানান, তার বড় ছেলে ডা. সোহেল মাহবুব আমেরিকা থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় তার পৌঁছানোর কথা। বড় ছেলে পৌঁছানোর পর খিলগাঁও মাটির মসজিদে বাদ জোহর পঞ্চম দফায় জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। জানা যায়, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত শনিবার রাত পৌনে ১১টায় মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে খন্দকার মাহবুবের বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি স্ত্রী ফারাত হোসেনসহ দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
বিএনপির শ্রদ্ধা : রোববার সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মরহুমের কফিনে দলীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদন করে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে অন্যরা। মরহুম খন্দকার মাহবুব হোসেনের প্রতি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান। পরে ড. মোশাররফ বলেন, ‘তার মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে, এটা পূরণ হওয়ার নয়। আইনজীবীরা তাদের অভিভাবক হারাল। আমরা জাতীয়তাবাদী আদর্শের একজন নেতাকে হারালাম।’ এ সময় মরহুমের ছেলে খন্দকার শামীম হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাবার আত্মার জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
এ সময় জানাজায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, ফজলুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, মো. আব্দুর রহিম, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাপগা) বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান।
খন্দকার মাহবুবের জন্ম ১৯৩৮ সালের ২০ মার্চ বরগুনার বামনায়। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালের ৩১ জানুয়ারি আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। তার মেধা ও প্রজ্ঞার কারণে পরিচিতি পান ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলা পরিচালনা করে সুনাম অর্জন করেন। আদালতে আইনগত পরামর্শ দানকারী (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবেও দেন অনেক মতামত। তুমুল জনপ্রিয় এই আইনজীবী চারবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া তিনি দুই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন ২০০৮ সালে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। এরপর ২০১৬ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজসেবামূলক নানা কাজে যুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত এই আইনজীবী। অন্ধ ও পঙ্গুদের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (ভিটিসিবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি তিনি। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার উপদেষ্টা এবং জসীমউদ্দীন পরিষদের সম্মানীত পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ইউনিয়ন, এশিয়ান ব্লাইন্ড ইউনিয়ন ও ঢাকা রোটারি ক্লাবের সদস্য ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তিনি। ওই আসন থেকে আগেও অন্য দল থেকে একাধিক বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি।
উৎসঃ দৈনিক কাল বেলা