তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: সবে মাত্র আর ৮টি রাত পেরোলেই দেখা মিলবে ভোটের-রবির। দিনটি রোববার ৭ জানুয়ারি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সেই সকালের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে স্নায়ুচাপের সাথে বাড়ছে নখ কামড়ানো উত্তেজনাও। দিন ঘনিয়ে আসায় উৎসব মুখর পরিবেশ পাড়া-মহল্লায়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রার্থী আর সমর্থকেরা ছুটছেন ভোটারদের কাছে। এরমধ্যে কথার জমাট লড়াই ভোটের মাঠে। প্রচার-প্রচারণায় প্রতিদিনই চলছে বাহাস। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে ভোটের সমীকরণ। এমন অবস্থা মৌলভীবাজার-২ আসনে। এই আসনে ৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তবে মূল লড়াই হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএম সফি আহমদ সলমান ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীনের মধ্যে।
এ তিন প্রার্থীর মধ্যে প্রচার-প্রচারণায় বক্তব্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএম সফি আহমদ সলমানের মধ্যে চলছে কথার লড়াই। প্রচার সভার বক্তব্যে একজন আরেকজনকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য রাখছেন। এতে বাড়ছে উত্তাপ।অন্যদিকে নিরব প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। পৌষের দুপুরে গত সোমবার কাদিপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে দিনের প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যান নাদেল। এদিন বিকেলে স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচারণা চলাকালে পথসভায় বক্তব্য দেন শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।বক্তব্যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর (সফি আহমদ) বিভিন্ন সভায় দেওয়া সমালোচনামূলক বক্তব্যের কড়া জবাব দেন নাদেল। সরাসরি নাম না বললেও তার বক্তব্য যে স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএম সফি আহমদ সলমানকে ইঙ্গিত করে, তা স্পষ্টতই বুঝা গেছে। নাদেল বলেন, ‘‘বিভিন্ন মানুষকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কোনো নেতাকর্মী, ভোটারকে যদি হুমকি দেওয়া হয়, কারও দিকে যদি আঙুল তোলা হয়, সেই আঙুলের ঠিকানা কোথায় হবে; এই ৭ তারিখ তা আমরা দেখিয়ে দেব।‘‘আমরা উন্নয়ন চাই, শান্তি চাই। আমরা সন্ত্রাস চাই না। আমরা মান-সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ আছে? কুলাউড়া উপজেলা সদরের কাছের একটি ইউনিয়ন কাদিপুর। এই ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছি। সদরের কাছের একটি ইউনিয়ন। বেশিরভাগ রাস্তা এখনও কাঁচা। মানুষের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।‘‘যারা বছরের পর বছর আপনাদের ভোট নিয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা কী করেছেন। সেটা আমার চেয়ে আপনারা ভালো জানেন।’’ ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন নাদেল।
পথসভায় উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে নাদেল বলেন, ‘‘আমরা পর পর তিনটা নির্বাচনে কুলাউড়ায় ট্রেন মিস করেছি। বাংলাদেশ আজকে কোথায়। আমাদের কুলাউড়া কোথায়! সারাদেশ এগিয়েছে, আর আমরা পেছনে পড়ে আছি। এই কারণে আজকে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যারা জীবনে নৌকায় ভোট দেননি। তারাও আজকে নৌকায় সমর্থন জানিয়েছেন।’’নাদেল বলেন, ‘‘বিগত ইউনিয়ন নির্বাচন বলেন, উপজেলা নির্বাচন বলেন; অনেক অনিয়ম হয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে। আমরা কি আবারও এগুলো দেখতে চাই? যারা বিগত নির্বাচনগুলোর মতো চিন্তাভাবনা করছেন, তাদের বলছি। তারা নিজেদেরকে সংশোধন করুন। ভোটারদের ভয় দেখিয়ে নয়, হুমকি দিয়ে নয়। মানুষের ভোট, মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলুন। এই কুলাউড়ার মানুষকে হুমকি দিয়ে ভোট আদায় করা যাবে না।’’‘‘কোনো কোনো জায়গায় পায়ে ধরেন। আবার আরেকটা হাত ঘাড়ের ওপর রাখেন। এইগুলো মানুষ বুঝে গিয়েছে। গুন্ডামি, জমি দখল, আমানতের টাকা খেয়ানত। অনেক মানুষ সহ্য করেছে। অনেক সম্মানিত মানুষ অসম্মানিত হয়েছে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সময় হয়েছে কুলাউড়ার মানুষ জবাব দেবে। ৭ তারিখের অপেক্ষায়। এই জনপদ কোনো সন্ত্রাসী বা কোনো বাটপারের কাছে যাবে না।’’অপরদিকে এরআগের দিন এক সভায় স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএম সফি আহমদ সলমান বলেন, ‘‘বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সমাবেশে আমাকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। আমার সমর্থকদের হুমকি-ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমি কুলাউড়ার নাগরিক। কুলাউড়ায় আমার জন্ম। আমি বা আমার অনুসারী কাউকে কুলাউড়ায় উঠতে দেবেন না। এমন কোনো বাবার সন্তান এ মাটিতে জন্ম গ্রহণ করে নাই।‘‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই। আর যদি এ ধরনের কথা শুনি, যেখানে শুনবো সেখানেই ঠেকিয়ে দেবো।’’গত মঙ্গলবার এক সভায় সফি আহমদ সলমান বলেন, ‘‘এবার এম এম শাহিন সাহেবও আসছেন। তিনি প্রথমে আসলেন ফুটবল মার্কা নিয়ে, এরপর ধানের শীষ, এরপর নৌকা নিয়ে। এবার বিএনপির জম, তৃণমূল মূল বিএনপির পাট (সোনালী আঁশ) মার্কা নিয়ে।‘‘আরেকজন এসেছেন। তার বাবার বাড়ি কুলাউড়ার কৌলা গ্রামে। জন্ম সিলেটে। রাজনীতি সিলেটে। থাকেন সিলেট এবং ধানমন্ডিতে। দায়িত্ব তার ময়মনসিংহ বিভাগে।’’সফি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘বিগত দিনে যাদের ভোট দিয়েছেন। তাদের পেয়েছেন? বন্যা গেলো, করোনা গেলো। ট্রেন দুর্ঘটনা গেলো। ভয়বাহ দুর্যোগে তাদের পেয়েছেন। বর্তমান-সাবেক এমপি কেউ নেই। কুলাউড়ার জনগন যেনো আল্লার হাওলা।‘‘আমি আপনাদের সন্তান। আমি এখন জীবন সায়াহ্নে। আমাকে ভোট দিয়ে কুলাউড়ার ভাগ্যাকাশ থেকে দুর্যোগের ঘনঘটাটা সরিয়ে দিন। আমাকে নির্বাচিত করুন। আমি আপনাদের পাশে থাকব।’’আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে কারা ঘিরে রেখেছে, দেখছেন। একটা দালাল চক্র। একটা চাটুকার চক্র। আপনারা ভোট দিবেন, ভোট চলে যাবে ময়মনসিং। ভোট দিবেন প্রার্থী চলে যাবে ঢাকা। আর কুলাউড়ার মানুষ এই দালালদের কপ্পরে থাকতে হবে।’’গত বুধবারের সভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এক প্রার্থীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘আজকে এই দলে, কালকে ওই দলে। তার পরেরদিন আরেক দলে। আপনি একদল করবেন, তালাক দিবেন। এরপরে আরেক দল করবেন, তালাক দিবেন। তালাকনামা মানুষের সামনে ছিড়ে ফেলবেন। আবার সেই বউ নিয়ে ঘুরাফেরা করবেন। লজ্জা শরমতো থাকা উচিত। এরকম নিলজ্জ লোক কুলাউড়ায় দুই চারটা আছে।’’‘‘আওয়ামী লীগ করেছি। আপনাদের দোয়া ভালোবাসায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করছি। সেই দায়িত্ব পালন করাটাকেও নিয়েও কেউ কেউ কটাক্ষ করেছেন। কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করায় আমার এলাকার জন্য ভালো কিছু করার সুযোগ আছে। এটাকে নিয়েও যদি কটাক্ষ করা হয়। আরও অনেক কিছু তো বলা যেত।’’নাদেল বলেন, ‘‘কিছু কিছু মানুষ আছে আমাদের সমাজে, দুই মাস-চার মাস পর পর মোবাইল নম্বর বদলায়। মোবাইল নম্বর পাল্টায়। মানুষের কাছ থেকে টাকা নিলো। সেই টাকা ফেরত দিবে না। চাকরির কথা বলে নিবে। মামলার তদবিরের কথা বলে নিবে বা অন্য কথা বলে। সেই কাজ টা করার জন্য নেয়নি। হজম করার জন্য নিয়েছে। যারা কিছু দিন পর পর যারা নম্বর বদলায় তাদের কি বলে বাটপার…।’’
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-২ আসন। এ আসনের ১৩টি ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভায় মোট ভোটার রয়েছেন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭২। এরমধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৩৫ এবং মহিলা ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ জন। মোট ভোট কেন্দ্র ১০৩।২০০১ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৮ পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। তাই এবার আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো দলের মনোনয়ন পান দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।এখানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন (সোনালী আঁশ) নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমান (ট্রাক)। ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে তিনি ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতা করে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়ী হন। এছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতায় রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মতিন (কাঁচি), জাতীয় পার্টির আব্দুল মালিক (লাঙ্গল), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এনামুল হক মাহতাব (মোমবাতি), ইসলামী ঐক্যজোটের আছলাম হোসাইন রহমানী (মিনার) ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মো. কামরুজ্জামান সিমু (কুলা) প্রতিকে নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।