তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: দাম কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন মৌলভীবাজারের লেবু ব্যবসায়ীরা। শীতকালে এমনিতেই লেবুর উৎপাদন কিছুটা কম হয়। এর মধ্যে চাহিদা ও দাম কমায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন এখানকার প্রায় দুই হাজার লেবু বাগানের মালিক। বাজারে দাম কমায় শ্রমিক ও পরিবহন খরচও উঠছে না অনেক সময়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুন লেবু বাগান গড়ে তোলা ও লেবুর উৎপাদন বাড়ায় মৌলভীবাজারের লেবু ব্যবসায় ধস নেমেছে বলে ধারণা খাতসংশ্লিষ্টদের।
শ্রীমঙ্গলের লেবুর আড়ত ও ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার সবচেয়ে বড় লেবু পাইকারি বাজার শ্রীমঙ্গলে। এ বাজার থেকে প্রতি বছর এই মৌসুমে দিনে ছয় থেকে আট লাখ লেবু বিক্রি হতো। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এসব লেবু কিনে নিয়ে যেতেন। দামও ছিল ভালো। কিন্তু এবার বিক্রি কমে নেমেছে ৩ থেকে ৪ লাখে। দামও কমেছে প্রায় অর্ধেক। গত বছর এই সময়ে প্রতিটি লেবুর পাইকারি দাম ছিল ২-৪ টাকা কিন্তু চলতি বছরের এ সময়ে দাম ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে।
লেবু ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও শ্রীমঙ্গল লাগোয়া হবিগঞ্জের বাহুবল ও চুনারুঘাটের পাহাড়ি এলাকায় দুই হাজার লেবুবাগান রয়েছে। এসব বাগানের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গলের আড়ত থেকেই এসব বাগানের লেবু দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। শ্রীমঙ্গলে লেবু সমিতির আওতাধীন ২২টি গুদাম ছাড়াও ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ীর নিজস্ব গুদাম রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর প্রথম দিকে বিরূপ আবহাওয়ায় লেবুবাগানের কিছু ক্ষতি হলেও পরিমিত বৃষ্টিপাতের কারণে ফলন ভালোই হয়েছে। একসময় সেপ্টেম্বরেই লেবুর মৌসুম শেষ হয়ে যেত কিন্তু বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ও উচ্চফলনশীল চারা রোপণের কারণে সারা বছরই লেবু উৎপাদন হচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, বিভিন্নভাবে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে লেবু দেশের বাজারে প্রবেশ করায় স্থানীয় বাজারে দাম কমে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া বর্তমানে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লেবু চাষের ফলে শ্রীমঙ্গলের লেবু বাজারে ধস নেমেছে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের। এজন্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
শ্রীমঙ্গলের একটি লেবু বাগানের মালিক ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী শিপলু জানান, করোনাকালে লেবুর বাড়তি চাহিদা থাকায় বাগান মালিকরা অনেক লাভ করেছেন। এজন্য অনেকে নতুন করে আবাদ বৃদ্ধি করেছেন, কিন্তু বর্তমানে বাজারে দাম এতই কমেছে, লেবু বিক্রি করে এখন যে অর্থ পাওয়া যায়, তা দিয়ে শ্রমিকের মজুরি এবং আড়তে পৌঁছতে গাড়ি ভাড়া দিয়ে আর কিছু থাকে না। ফসল নষ্ট হবে এজন্য বাজারে বিক্রির জন্য পাঠাই। নয় তো কেউই বাজারে ফসল নিয়ে যেত না। অনেক চাষী গাছ থেকে লেবু লাঠি দিয়ে নিচে ফেলে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
শ্রীমঙ্গলের শিবিরবাড়ী খাস এলাকার লেবুচাষী লিটন মিয়া জানান, বাগান থেকে এক গাড়ি (২ হাজার পিস) লেবু পাড়তে মজুরি দিতে হয় ৭৫০ টাকা। বাজারে পৌঁছাতে গাড়ি ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা মিলে মোট খরচ হয় ১ হাজার ৭৫০ টাকা। এ ফসল বাজারে ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়। একদিন ২০০ টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে পরের দিন খরচের টাকাই মেলে না।
লেবুচাষী সামছুল হক জানান, এ বছর তিনি ৩০ একর জমিতে লেবু চাষ করেছেন। কিন্তু লেবু বিক্রি করে শ্রমিক ও উৎপাদন খরচ মিলছে না। কৃষি বিভাগ থেকেও কোনো ধরনের সহায়তা মিলছে না। এ অবস্থায় চাষীরা লেবু চাষে উৎসাহ হারাতে পারেন।
শ্রীমঙ্গলের লেবু ঘরের পরিচালক আশুতোষ চক্রবর্তী জানান, লেবুর বাজারে এ বছর বড় পরিবর্তন এসেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলটির চাষ বেড়েছে। আগে প্রায় সারা দেশে লেবুর চাহিদা পূরণ করত শ্রীমঙ্গলের বাজার এখন সেটা পরিবর্তন হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের লেবু না গেলেও দেশের চাহিদা পূরণ হবে অন্যান্য এলাকার লেবু দিয়ে। এটা দাম কমার অন্যতম কারণ।
শ্রীমঙ্গল আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার লেবুর দাম কমেছে তিন গুণ। এজন্য চাষীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি লেবু ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মৌলভীবাজারে এ বছর ১ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়েছে। জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জসহ সাত উপজেলা এবং হবিগঞ্জের বাহুবল ও চুনারুঘাটের পাহাড়-টিলার মাটি আবহাওয়া লেবু চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এসব এলাকায় কাগজি, চায়না, জারা, পাতি ও কাটা লেবু বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বেশি হয় শ্রীমঙ্গলে।
মৌলভীবাজারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, কৃষককে তারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। বাজার দর ওঠানামা করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তবে চাষীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।