বাংলাদেশের ক্রিকেট সঠিক পথে এগোচ্ছে না বলেই মনে করছেন পেশায় ডাক্তার এই পাঠক। দেশের আরও নানা ক্ষেত্রের মতো দুর্নীতির কালো ছায়া ক্রিকেটেও ঢুকেছে বলেই ধারণা তাঁর। তবে অন্যায়ের জবাব তো আর পাল্টা অন্যায় করে দেওয়া যায় না, সাকিব আল হাসানের অক্রিকেটীয় আচরণও তাই সমর্থনযোগ্য মনে হচ্ছে না তাঁর কাছে।
সাকিব আল হাসান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে আবাহনীর বিপক্ষে ইনিংসের পঞ্চম ওভারের ষষ্ঠ বলে আম্পায়ারের এলবিডব্লিউর আবেদন নাকচের প্রেক্ষিতে যে ঘটনা ঘটিয়েছেন সেই মুহূর্তটি লাইভ দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য টেবিলে মোবাইল রেখে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই মুহূর্তের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল। বিসিবির অফিসিয়াল পেজে লাইভে ছিলাম আমরা ৪২ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই মুহূর্তের রিপ্লে যখন দেখানো হয়, তখন বউকে মোবাইল ঘুরিয়ে বলি–‘ঘটনাটা দেখে নাও, সন্ধ্যার পর এটাই হবে দেশের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয়।’
হলোও তাই। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ক্রিকেট পাড়া থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ল ঘটনাটি। শুধু বাংলাদেশ কেন, ক্রিকেট মাঠে ১৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা একজন বিশ্বপরিচিতের এমন বিস্ময়কর ঘটনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তেও সময় নেয়নি।
বাকি দেশের কথা বাদই দিলাম। দেশের মানুষ এই বিষয়ে পুরোপুরি দুই পক্ষে বিভক্ত। এক পক্ষ বলছেন,সাকিবের এই কাজটি ক্রিকেট নামক ভদ্রলোকের খেলার স্পিরিটের পরিপন্থী। সংবাদমাধ্যম থেকে ক্রিকেট আলোচক সবাই এই গ্রুপে। অপরপক্ষ সাকিবের এই বিস্ময়জাগানিয়া কর্মকান্ডকে একরকম নায়কোচিত আচরণ হিসেবে প্রমান করার চেষ্টা করছেন। তাদের মতে, দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যায়ের সাম্রাজ্যে লাথি দিয়ে সাকিব ন্যায়ের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সাকিব নিজে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরও দ্বিতীয় পক্ষের সংখ্যা প্রথম পক্ষের কয়েকশত থেকে কয়েক লক্ষগুণ বেশি।
আসলে কী হতে পারে? কী কারণে সাকিবই বা এরকম দৃষ্টিকটু কাজ করতে গেলেন? এর সঠিক উত্তর খোদ সাকিবই ভালো দিতে পারবেন। তবে ক্রিকেট বিশ্লেষক, আলোচক কিংবা ক্রিকেটকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা মানুষরা এটাকে সাকিবের মানবিক ভুল হিসেবে আখ্যা দিতে চাইছেন, যেই ভুল সাকিব ক্যারিয়ারে বহুবার করেছেন।
আমি পেশায় ডাক্তার এবং ক্রিকেটের নিবিড় পর্যবেক্ষক। আমি সাকিবের এই ঘটনাকে ‘মুহূর্তের মতিভ্রম’ বলতে চাই। হতে পারে সেটা ক্রিকেটের ভাষায় ‘প্লাম্ব আউট’; যা নাকচেও এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল মুন্সিয়ানা আম্পায়ার দেখাতে পারতেন কিন্তু তা তিনি পারেননি, হয়তো নীতিগতভাবে উনিও ততটা শক্তশালী ছিলেন না। তারপরও সাকিব আল হাসানের এই আচরণ অক্রিকেটীয়, অপেশাদার এবং ক্রিকেটে নামক খেলাটার স্পিরিট বহির্ভূত।
আচ্ছা, এই যে একটা ঘটনায় সাধারণ দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ক্রিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট বিশ্লেষক, পর্যবেক্ষকের বিস্তর ফারাক, এটা কেন? আপনি একই ঘটনা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারত এমনকি শ্রীলঙ্কাতে আশা করতে পারবেন? অসম্ভব, ওসব দেশে এই ঘটনা কল্পনাই করতে পারবেন না। কারণ কী? কারণ হচ্ছে ,তাদের দেশে উন্নত একটি ক্রিকেট কালচার আছে, যেটা আমাদের দেশে নাই।
ক্রিকেট কালচার বাস্তুসংস্থানের মতো সামগ্রিক জিনিস। সেই কালচারে দর্শক, বোর্ড, ক্রিকেটার, সাংবাদিক, ক্রিকেট বিশ্লেষক, সমালোচক…সবাই জড়িত। দেশের সিংহভাগ ক্রিকেট সমর্থকের ক্রিকেট স্পিরিট নিয়ে এই অবস্থান, সেই বাস্তুসংস্থান ঠিকমতো টিকিয়ে রাখতে পারবে বলে আপনি কীভাবে আশা করেন? আর দেশের প্রতিটা ক্ষেত্র যেখানে দুর্নীতিগ্রস্থ, ক্রিকেট বোর্ড কি সেখানে ফেরেশতারা এসে পরিচালনা করেন? সেই বোর্ড থেকে উঠে আসা ক্রিকেটার, দেশের তথা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফর্মার কি সেই বোর্ডকে বোর্ডের যথাযথ মর্যাদা দেবে?
বিষয়টা বাস্তুতন্ত্রে টান পড়ার মত; একটিতে অসামঞ্জস্য থাকলে অন্যটির খেলো অবস্থা চোখের সামনে ভেসে উঠে। তারপরও একজন ক্রিকেটার হয়ে আপনি সিস্টেমের বাইরে যেতে পারেন না। সেই সিস্টেম পরিচালনা করে বোর্ড, ক্রিকেটার হিসেবে আপনি আপনার সব ক্রিকেটীয় এবং অক্রিকেটীয় কাজের জন্য বোর্ডের নিকট দায়বদ্ধ। আর বোর্ডেরও সেই নৈতিক ভিত্তি থাকতে হবে, যাতে যেকোনো ধরনের অক্রিকেটীয় আচরণের ব্যাপারে তারা স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
নৈতিক ভিত্তি বলা হয়েছে, কারণ বাংলাদেশের অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো বিসিবিও প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাধারণ দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে। দেশের জাতীয় দল ছাড়া বাকি ক্রিকেটার তৈরির যতগুলো প্রসেস আছে, সবগুলোর দুর্নীতির গল্প ক্রিকেট পাড়ায় ওপেন সিক্রেট থেকেও নিচে নেমে ‘বেহায়া সিক্রেটে’ পরিণত হয়েছে। প্রিমিয়ার লিগ, থার্ড ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, বয়সভিত্তিক খেলায় আম্পায়ার আর বোর্ড কর্মকর্তাদের বেহায়া পক্ষপাতিত্ব বোর্ডকে আজ সাকিব আল হাসানের ঘৃণিত ক্রিকেট আচরণের বিপরীতেও ভিলেন বানাচ্ছে।
তারপরও বোর্ডকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নৈতিক ভিত্তি না থাকলেও বোর্ড সাকিব আল হাসানকে ৩ ম্যাচ নিষিদ্ধ আর ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে। বোর্ডকে এটা করতেই হতো। বোর্ড যে সিস্টেমের পরিচালক, সেই বোর্ডের মানুষ পরিবর্তন হবে, নতুনরা এসে কাজ করবে, একজন ক্রিকেটার বোর্ড থেকে বড় নয়, এই বোধ সেই ক্রিকেটারসহ পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে দিতে হবে।
শামসুর রাহমান বলেছিলেন- ‘এক অদ্ভূত উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ আর এদিকে এক অদ্ভূত ভূতের পিছে চলেছে স্বদেশের ক্রিকেট। আমাদের ক্রিকেটে ২১ বছরে টেস্টে বড় দলের বিপক্ষে জয় তিনটি, ওয়ানডেতে ৮/৯ নম্বরে অবস্থান, টি-২০ খেলার জন্য কোনো পাওয়ার হিটার নাই–তাও কোনো এক অদৃশ্য কারণে নিজেদের ক্রিকেটের পরাশক্তি ভেবে পুলকিত হই।
ক্রিকেট খেলাটার প্রতি খুবই আলাদা একটা ভালো লাগার জন্য একেবারে গ্রামীণ পর্যায়ে একটি ক্রিকেট সংগঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ইচ্ছে আছে, সেখান থেকে কোনো একদিন দেশের ক্রিকেটে ক্রিকেটার সাপ্লাই দেওয়া। সাকিবের এই কর্মকাণ্ডে অনেকে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তাদের জবাব দিয়েছিলাম, সাকিব যদি আমাদের সংগঠনের কোনো ক্রিকেটার হতেন, তাহলে ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাচ রেফারির রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁকে ৪ ম্যাচ নিষিদ্ধ আর সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করতাম। সেই সাথে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারদের এরকম স্পিরিট বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহিত করতে পুরো টুর্নামেন্টসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একটা সময় সীমা পর্যন্ত নিষিদ্ধ রাখার প্রস্তাব করতাম। কারণ একজন সাকিব আল হাসান কখনো বোর্ড থেকে বড় হতে পারেন না; বোর্ড সঠিক পথে এগোলে সাকিব আল হাসান না হলেও বিশ্ব ক্রিকেটে সমীহ জাগানিয়া ক্রিকেটার তৈরি করতে পারবে।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে এত কিছু লেখার মানে এটা মনে করবেন না, আমি সাকিব-বিদ্বেষী। আমার বাসায় একটা রুম আছে, যাতে আমি ইচ্ছা করে কোনো বেড রাখিনি; এই রুমটার নাম দিয়েছি সাকিব আল হাসান রুম। সাকিবকে নিয়ে যেকোনো নিউজ, ছবি, আর্টিকেল, ম্যাগাজিন…এই রুমে সংরক্ষণ করে রাখি। মনের কোণে একটা ক্ষীণ আশা আছে, কোনো না কোনোদিন আমাদের ক্রিকেট আকাশের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র এই রুমে পা রাখবেন আর রুমটি তার নামের সার্থকতা পাবে। তার মানে এই নয় যে, আমাদের ক্রিকেট সুপারস্টার ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। অন্যায় সাম্রাজ্য আমরা সাকিবের অপেশাদার লাথি দিয়ে ভাঙতে পারব না–এই বোধটা আমাদের মতো সাকিব-সমর্থকসহ সকল ক্রিকেটানুরাগীদের থাকা উচিত।
লেখকঃ ডা. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ