‘কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ’-এর নামে নিবন্ধন ছাড়াই স্বর্ণ ব্যবসার আড়ালে পণ্য লেনদেনে নেমেছে দুই প্রতিষ্ঠান। রিলায়েবল কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি এবং বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ব্যবসা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি শেয়ারবাজারসহ কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমতি না নিয়েই এ ধরনের পণ্যের ব্যবসা শুরু করায় ব্যাখ্যা তলব করেছে। সম্প্রতি এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ সম্পর্কিত ব্যবসা শুরু করার বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এই কোম্পানির অন্যতম অংশীদার রাশেক রহমান, যার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। গত মাসে এই প্রতিষ্ঠান দুটির উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও কুমিল্লায় অফিস নেওয়া হয়েছে বলে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। রংপুরের মুন্সীপাড়ায় বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির অফিস নেওয়া হয়েছে। এলাকায় কমোডিটি বা পণ্য বিক্রির মাধ্যমে নানা মুনাফার কথা ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম করেছে। এই কোম্পানির সঙ্গে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানও জড়িত আছেন। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ করার বিষয়ে বাংলাদেশের আইন অনুসারে এর নিয়ন্ত্রক বিএসইসি। বিএসইসির অনুমতি নিয়েই কেবল এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠান করা যায়। তবে তারা সেসব কিছু না নিয়ে কার্যক্রম শুরু করায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি রিলায়েবল কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি এবং বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও অবহিত করা হয়েছে।
বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর ধারা ৮(৪) অনুযায়ী, সদস্যভুক্ত কোনো ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোনো সিকিউরিটিজের জন্য ব্রোকার বা ডিলার হিসেবে কাজ করবে না। ফলে এ পরিস্থিতিতে কমিশনের অনুমোদন ছাড়া বা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য না হয়েও কমোডিটি ফিউচার কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে ব্যবসা করার প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়ে আপনাদের অবস্থান জানতে চায় কমিশন। এ চিঠি জারি করার সাত কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কমোডিটি ফিউচার কন্ট্রাক্ট সংক্রান্ত বিষয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর ধারা ২ (সিসিসি) অনুযায়ী, কমোডিটি এক্সচেঞ্জে নগদ বা অফসেট কমিশনের সঙ্গে যথাযথভাবে নিবন্ধিত। কমোডিটি পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, বনজ, খনিজ বা এনার্জি এবং এ-জাতীয় পণ্য থেকে তৈরি বা প্রক্রিয়াজাত দ্রব্যাদি। এ ছাড়া কমিশন কর্তৃক সরকারি গেজেটের মাধ্যমে অবহিত করা যে কোনো পণ্য/দ্রব্যাদি হতে পারে। আর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর ধারা ২(১)(৩) অনুসারে, কমোডিটি ফিউচার কন্ট্রাক্টকে নিরাপত্তা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল রাজধানীর বনানীতে নিজের স্বর্ণ ব্যবসার শো-রুম উদ্বোধন করেন সাকিব আল হাসান। কিউরিয়াস লাইফ স্টাইলের সঙ্গে যৌথভাবে স্বর্ণ ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন তিনি। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সবাই যাতে চাইলে স্বর্ণ কিনতে পারে, সেই উদ্যোগ নিয়েছে সাকিবের প্রতিষ্ঠান। সে জন্য ‘সুইস মেড ২৪কে মিন্টেড গোল্ড বারস’ ১ থেকে ১০০ গ্রামের স্বর্ণ কেনার সুযোগ রাখা হয়েছে। সাকিবের বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডিলার হিসেবে অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে ঢাকা, রংপুর ও কুমিল্লায় তিনটি অফিস দিয়ে বিদেশ থেকে সোনার বার ও অলঙ্কার আমদানি করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, “ঢাকায় নিবন্ধিত রিলায়েবল কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও রংপুরে নিবন্ধিত বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি দুটির নামের সঙ্গে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ আছে বলে তারা আসলে কী করছে আমরা জানতে চেয়েছি। যদি কোনো কোম্পানি ‘ফিউচার কনন্ট্রাক্টে’ পণ্য লেনদেনের ব্যবসায় যুক্ত থাকে তবে অবশ্যই তাদের বিএসইসির অনুমতি নিতে হবে। রিলায়েবল ও বুরাক ফিউচার কন্ট্রাক্টের অনুমোদন দেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা রাখে বিএসইসি। অন্য কেউ এই লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না।”
মূলত, কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। কিন্তু বিএসইসির কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে ব্যবসা শুরু করে ওই দুটি কোম্পানি। ‘রিলায়েবল কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ এবং ‘বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ নামের প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে সম্প্রতি বিএসইসি থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিএসইসির সহকারী পরিচালক মো. মোসাব্বির আল আশিকের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়েছে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ অনুযায়ী সাকিবের মালিকানাধীন কোম্পানি দুটি স্বর্ণ ব্যবসায় যুক্ত হতে পারবে না।
সূত্র জানায়, সাকিবের বুরাক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি সোনার বার ও অলঙ্কার বৈধভাবে আমদানি ও বিক্রির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন পায়। তবে কোম্পানি দুটি সোনার ব্যবসা করার জন্য বিএসইসির কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি বলেও জানায় সূত্র।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘বিএসইসির অনুমতি ছাড়া কেউ কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে। তা যদি কেউ করে থাকে তাহলে বিএসইসি ঠিকই করেছে।’
জানতে চাইলে রিলায়েবল কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেডের অংশীদার রাশেক রহমান বলেন, ‘বিএসইসির অভিযোগ বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের আইন মেনে স্বর্ণ ব্যবসা করছি। অভিযোগ বোধগম্য হলে বিএসইসির চিঠির উত্তর দিতে পারি, নাও দিতে পারি।’ তিনি দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠান দুটির নামের সঙ্গে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শব্দটি থাকলেও তারা এ-জাতীয় কোনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন।
রেস্টুরেন্ট, হোটেল, পুঁজিবাজার, প্রসাধনী, চিংড়ি ঘের, ট্রাভেল এজেন্সি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ই-কমার্সের পর সাকিব এবার স্বর্ণ ব্যবসা শুরু করেছেন। এ ছাড়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হওয়ার জন্য আবেদন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি।
উৎসঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন