কমপক্ষে এক দশক আগে, বাংলাদেশ প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল, প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী বা সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মধ্যে প্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। আমরা যে এটা করতে পারি, খুব বেশি মানুষ এটা বিশ্বাস করেননি।
সর্বোপরি, ২০০৯ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (প্রকল্পের চিফ চ্যাম্পিয়ন) দায়িত্ব নিলেন, তখন মাত্র ২ কোটি বাংলাদেশির হাতে মোবাইল ফোন ছিল। কিন্তু এখন কমপক্ষে ১২ কোটি বাংলাদেশির হাতে মোবাইল ফোন আছে। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের কাছে উচ্চ গতির (ইন্টারনেট) সংযোগ আছে। এর ফলে অগণিত মানুষের জীবন উন্নত ও নিরাপদ হয়েছে। ২০০৯ সালে উচ্চাভিলাষী ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়- শ্রমঘন কাগজভিত্তিক সরকারি সেবাকে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ভিত্তিক প্রোগ্রাম ব্যবহার করে আরো সহজ করে তোলা। ই-সিগনেচার এবং ইলেকট্রনিক উপায়ে ফাইল করার ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে এবং উৎসাহিত করা হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে সরকার ৮৫০০ ডিজিটাল সেন্টার নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে। এর মধ্য দিয়ে জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত অনলাইন সেবা আক্ষরিক অর্থেই দেয়া হচ্ছে। এর ফলে জন্ম নিবন্ধন সহায়ক হয়েছে। স্থানীয় চাকরির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় অনলাইন সুবিধা পাচ্ছে মানুষ। বহু জাতীয় কর্মসূচি এখন চলে গেছে অনলাইনে। গত বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বাধ্য হয়ে যখন লকডাউন দেয়া হয়, তখন সরকারি সেবায় কোনো বিঘœ ঘটেনি। নতুন বিচারিক পোর্টাল ব্যবহার করে আদালত তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। কৃষিভিত্তিক একটি পোর্টাল থেকে কৃষকরা আবহাওয়া সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আপডেট এবং অন্যান্য তথ্য বা ডাটা জানতে পেরেছেন। পরিব্যাপ্ত মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত তথ্য প্রায় সব নাগরিককে জানানো হয়েছে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ পোর্টালগুলোর অন্যতম হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের পোর্টালগুলো নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। সেটা হলো প্রায় প্রতিটি সরকারি সেবায় ইন্টারনেট লিঙ্ক স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো স্মার্টফোনের মাধ্যমে সরকারি সেবার শতকরা ৮৫ ভাগই নাগরিকদের আঙ্গুলের স্পর্শের মধ্যে এনে দেয়া। আর শতকরা ১০ ভাগ সেবা তাদের ঘরের দরজায় পৌঁছে দেয়া। এর বাইরে যে শতকরা ৫ ভাগ মানুষ থাকেন, তাদেরকে সরকারি অফিসগুলোতে যেতে হবে।
অনেক বেশি সরকারি কর্মসূচি এখন অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে প্রায় সবকিছু করছে। পাসপোর্ট পাওয়া থেকে শুরু করে ড্রাইভারদের লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন এখন অনলাইনে। নাটকীয়ভাবে চলছে এসব। এই সফলতার একটি মূল উপাদান হলো মোবাইল ফোন।
বাংলাদেশে এখন টোল-ফ্রি জাতীয় জরুরি সেবা বিষয়ক হেল্পলাইন ৯৯৯ আছে। নাগরিকরা কোনো দুর্ঘটনা, সাইবারক্রাইম থেকে শুরু করে অপরাধ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, অগ্নিকা- এবং চিকিৎসায় জরুরি সেবার জন্য এটি ব্যবহার করেন। জাতীয় হেল্প ডেস্ক প্রতি মিনিটে ৬০টি কলে সাড়া দিয়ে থাকে।
ধন্যবাদ জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য কৌশলের সঙ্গে যুক্তদের। টেলিমেডিসিন এখন শুধু সম্ভবই নয়, একটি সাধারণ বিষয়, বিশেষ করে অনগ্রসর গ্রামীণ এলাকায়। এ কর্মসূচি মৌলিক স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে থাকে, যা একটি সুস্থ জনসংখ্যাকে নেতৃত্ব দেয়। উপরন্তু, সরকার অধিক জবাবদিহিমূলক এবং দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে। অনলাইনে অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় বাংলাদেশিরা সহজেই সরকারি সেবা বা পণ্য সম্পর্কে অনলাইনে অভিযোগ জমা দিতে পারেন।
ব্যাপক সংযুক্তি বা কানেকটিভিটি দেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করছে। দক্ষ, ডিজিটাল-রেডি কর্মশক্তি গড়ে তোলার জন্য নেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এই উদ্দেশে বাংলাদেশ তার পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছে এবং বার্ষিক ৫ লাখ গ্রাজুয়েট কর্মী তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু গত বছর তথ্য প্রযুক্তি পেশায় এসেছেন কমপক্ষে ৬৫ হাজার মানুষ।
ডিজিটাল সেন্টারগুলো নিজেরাই কর্ম সৃষ্টির নিয়মক। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতি তিনটি পদের মধ্যে কমপক্ষে একজন নারী মনোনীত করার নিয়ম আছে।
দেশে ২৫ বছরের নিচে মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশের জন্য বাংলাদেশ হলো সাইবার কর্মীদের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র। এই সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন যুব সমাজ। অতীতে তাদের বেশির ভাগই নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজের জীবন বেছে নেয়ার কথা কল্পনাও করতেন না। কিন্তু বর্তমানে, তরুণ বাংলাদেশিরা ক্রমবর্ধমান হারে শহরমুখো, গতিশীল এবং নতুন অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে প্রস্তুত।
ডিজিটালকরণ থেকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সূচনা থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩ লাখ প্রযুক্তি পেশাদার বাংলাদেশকে তাদের ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। আছেন কমপক্ষে ১০ হাজার প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সেবা থেকে তারা সবাই মিলে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনছেন। অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর সূচনা থেকে বাংলাদেশিরা সেভ করেছেন ২০০ কোটি ঘন্টা সময়, ৮০০ কোটি ডলার এবং সরকারি অফিসে ১০০ কোটি বার যাওয়া।
আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ তারাদের দিকে ছুটেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তার প্রথম যোগাযোগ বিষয়ক স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছে। এই স্যাটেলাইট টেলিযোগাযোগ সেবাখাত বিন্যাসের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
কি এক বিস্ময়কর আরোহণ!
২০০৮ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা প্রায় ৫ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে এটা শতকরা ৮ ভাগের ওপরে। পর্যাপ্ত পরিমাণে উচ্চ মাত্রার কানেকশন এই প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদান রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। কিন্তু তার মধ্যে অল্প কিছু আছে যা দেশে নাটকীয় ইন্টারনেট যুগের চেয়ে বেশি চমকপ্রদ। এমনকি আমরা আমাদের ডিজিটাল বিশেষজ্ঞদের রপ্তানি করছি।
এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী মালদ্বীপ, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় ডিজিটালকরণের গতি বিস্তারে সহায়তা করছেন বাংলাদেশি প্রশিক্ষকরা। এটা যে সম্ভব হতে পারে তা এক দশক আগে কেউ চিন্তাও করতে পারতেন না।
(লেখক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা ও ছেলে। তার এই লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক থেকে অনুবাদ)