‘৭ মাস দেশে ছুটিতে আটকা পইড়া আছি। কোনও আয় নাই, ঋণ করে সংসার চালাইসি এই কয়মাস। ভাবসিলাম কাজ শুরু হলে বেতন দিয়া ঋণ শোধ করুম। কিন্তু টিকিটের কোনও খবর নাই। রিটার্ন টিকিট কইরা আসলাম তাও পাই না। না যাইতে পারলে আমার কিছুই থাকবো না। ঋণ শোধ করুম ক্যামনে, সংসার চালামু ক্যামনে’—এভাবেই কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন সৌদি আরব থেকে দেশে ছুটিতে আসা ফরিদপুরের আলাউদ্দিন। তিনি ১৯ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করেন।
করোনাকালে সৌদি আরব থেকে ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রায় ২৮ হাজার কর্মী। এছাড়া দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার অনেক আগেও এসে আটকা পড়েছেন অনেকেই। তবে তার সংখ্যা অজানা। ছুটিতে আসা এসব প্রবাসী কর্মীর অনেকেরই রিটার্ন টিকিট করা ছিল। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ফ্লাইট কম থাকায় টিকিট নিয়ে শুরু হয়েছে সংকট। ইকামা এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর সৌদি সরকারের বর্ধিত সর্বশেষ সময়সীমা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। এই সময়ের মধ্যে সৌদি আরব না গেলে কাজ হারাবেন অনেক প্রবাসী। তবে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সেই সময়সীমা আরও ২৪ দিন বাড়িয়েছে সৌদি সরকার। কিন্তু টিকিটের অনিশ্চয়তায় উৎকণ্ঠায় দিন পার করেছেন প্রবাসীরা।
তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শনিবার জানিয়েছেন , সৌদি যেতে টিকিটের কোনও সমস্যা হবে না। সবাই যেতে পারবেন সফর মাস শেষ হবার আগেই। নিজের টিকিটটা আগে সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সবাই একসঙ্গে টিকিট কাটার চেষ্টা করছেন বলে ভিড় হচ্ছে বা মনে হচ্ছে টিকিটের সংকট হচ্ছে, যা সত্য নয়। প্রয়োজনে ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়ানো হবে। অযথা হইচই বা তাড়াহুড়োর কোনও প্রয়োজন নেই।
এদিকে টিকিটের খোঁজে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ করছেন প্রবাসীরা। শনিবারও ৮ম দিনের মতো কাওরান বাজারে সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে ভিড় জমান প্রবাসীরা। এর আগে শুক্রবার রাতে ফ্লাইটের ৩ ঘণ্টা আগে করোনা সনদ পেয়ে দেশ ছেড়েছেন ৩০২ জন প্রবাসী। এর আগে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ২৫২ জন প্রবাসী সৌদি আরব যান।
ফরিদপুরের আলাউদ্দিন বলেন, ‘করোনা শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে দেশে ফিরসি। এরপর আটকা পড়ে গেসি। গত সপ্তাহের সোমবার থেকে টিকিটের জন্য চেষ্টা করতেসি। রিটার্ন টিকিট করা ছিল আমার। এখানে টিকিট দেওয়ার যে সিস্টেম সেটা আমরা বুঝতেসি না। যারা আগে আসছে, যাদের মেয়াদ কম আছে, তাদের আগে পাঠাক। এখন গণহারে টোকেন দিচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানে, এয়ার এরাবিয়াতে যারা আসছে তাদেরও টোকেন দেয় আবার সৌদি এয়ারলাইন্সে যারা আসছে তাদেরও দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি সময়মতো না যাইতে পারি আমাদের বাড়িঘরে অনেক সমস্যা হয়ে যাবে। আমরা ৮ মাস ধরে ঘরে বসে খাই, আমাদের অনেক টাকা ঋণ আছে। না গেলে চাকরি হারায় ফেলবো, চাকরি গেলে গিয়া এই টাকা শোধ করবো ক্যামনে। আমার এখন ৪ লাখ টাকার ঋণ আছে।’
শুক্কুর খান নামে আরেকজন বলেন, ‘আমি ১০ মাসে আগে আসছি। আমার যাওয়ার কথা ছিল মার্চে। মার্চের থেকে যদি ফ্লাইট দেওয়া শুরু করে, তাহলে তো ওই হিসাবে মানুষ আসলে সিরিয়াল অনুযায়ী যেতে পারে। আগে আসলে আগে চইলা গেলো। এখানে কোনও সিস্টেম পাইলাম না। আমি টোকেন পামু কবে আর যাবো কবে। অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। বাংলাদেশ বিমানের সিস্টেম সুন্দর, যারা আগে আসছে তারা আগে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীদের জীবনটাই অন্যরকম। একজন প্রবাসে থাকে আর বাড়িতে ৫-৭ জনের সংসার চালায়। আমরা খুশিতে দেশে আসি ঠিকই, চার মাসের ছুটিতে আসলে ৩ মাসই কোনোরকমে চলতে হয়। ঋণ করে চলি, আমরা ফেরত যাওয়ার পর সেটা শোধ করি। ৪ মাসের ছুটিতে আসছি, আমার এখন ১০ মাস চলে। তাহলে আমার পরিস্থিতি কি সেটা বুঝার বাকি থাকে না। আমরা যদি এখন না যেতে পারি আমাদের বহুত বড় একটা ক্ষতি হইয়া যাইবো।’
চাঁদপুরের মাহবুব আলম ৩ বছর ধরে কাজ করেন সৌদি আরব। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাই আছে, বোন আছে, মা বাবার দেখা শোনা চিকিৎসা খরচ সব আমার দেখতে হয়। আমরা যদি না যাইতে পারি তাহলে ক্যামনে কি করমু! করোনার মধ্যে নিজেদেরই চলতে অনেক কষ্ট হইসে।’
টিকিটের দুশ্চিন্তায় প্রহর গোনা এসব প্রবাসী জানান করোনার মধ্যে সংসার চালাতে ঋণ নিতে হয়েছে অনেকেরই। কেউ ২ লাখ, কেউ ৩ লাখ কেউবা ৫ লাখ টাকাও ঋণ নিয়েছে। কাজে না ফিরলে এই ঋণ শোধ করবে কীভাবে, এই চিন্তায় কপালে হাত তাদের। দেশে ফিরে আসা ৫৫৮ জন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি একটি জরিপ চালিয়েছিল গত মে মাসে। সেখানে তারা বলছেন, দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই এখন কোনও আয়ের উৎস নেই। নিজের সঞ্চয় দিয়ে তিন মাস বা তার বেশি সময় চলতে পারবেন এমন সংখ্যা ৩৩ শতাংশ। ৫২ শতাংশ বলছেন, তাদের জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) বিদেশফেরত ৫০ জন প্রবাসী কর্মীর ওপর গত জুন মাসে এক জরিপে দেখেছে, ৭৮ শতাংশ কর্মীর বিদেশে কিছু না কিছু পাওনা থেকে গেছে। এই পাওনার পরিমাণ কারও সাড়ে ৯ হাজার টাকা তো কারও ৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি বিদেশফেরত ২৬ শতাংশ কর্মীর কোনও পাওনা নেই বলে জানিয়েছে। রামরু জানায়, এই পাওনাগুলো মূলত তাদের পাওনা বেতন। এছাড়া রয়েছে কিছু স্থানীয় বন্ধুর বিপদে ধার দেওয়া, ভিসা রিনিউ করার জন্য দেওয়া টাকা।
নোয়াখালীর মাইনুদ্দিন ১৭ বছর ধরে কাজ করেন সৌদিতে। তিনি বলেন, ‘আমরা দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকায় আসছি টিকিটের জন্য। যাদের চিনিও না তাদের হাত পা ধরে বাসায় থাকা লাগতেসে, যেমন ব্যবহার করতেসে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। কোথায় থাকবো, কোথায় খাবো সেটারও কোনও নিশ্চয়তা নাই। এই টিকিটের জন্য ঢাকায় এসে আমাদের তেমন কোন আশ্রয়ের জায়গা নাই।’
ফরিদপুরের ফেরদৌস মোল্লা বলেন, ‘মেয়াদ যদি না বাড়ায় আমরা শেষ। সৌদি সরকার বাড়াইলে কোম্পানি বাড়াবে নাহলে বাড়াবে না বলে দিসে। করোনার কারণে অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেসে, তার চায় যে তাদের কর্মী না আসুক। এই করোনার মধ্যে চলসি ঋণ কইরা, ৪-৫ লাখ টাকার ঋণ আছে। সংসার খরচ তো চলতেসে না, কোত্থেকে আসবে ঋণ ছাড়া টাকা। জমানো টাকা কয়দিন থাকে! জমানো টাকা দিয়ে চলসি ২ মাস এরপর কী করমু, ঋণ নেওয়া ছাড়া তো উপায় নাই। যতগুলা লোক ছুটিতে আসছে সবারই ঋণ আছে।’
উল্লেখ্য, শুধুমাত্র করোনা সংক্রমণের (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর) সময় সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন ৩৬ হাজার ৩৪০ জন। এর মধ্যে আউটপাস নিয়ে এসেছেন ৭ হাজার ৯৯৯ জন এবং পাসপোর্টসহ এসেছেন ২৮ হাজার ৩৪১ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৩০ হাজার ৯৩৯ জন এবং নারী ৫ হাজার ৪০১ জন। আর বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী করোনার মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত এসেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার ২৬৫ জন। এদের বেশিরভাগই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন।
উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন