জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধ: শেখ হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ড, মামুনের পাঁচ বছর কারাদণ্ড

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যদিও আদালত মত প্রকাশ করেন যে তার অপরাধও সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য ছিল।

আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগের মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং একটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। অন্যদিকে কামাল তিনটি অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।

আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর), আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। সকাল ১১টায় বিচারকরা আসনে বসেন। একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি মামুনকে কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

মামলার প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হওয়ার অভিযোগে এই মামলা দায়ের হয়। গত ১৩ নভেম্বর রায়ের তারিখ ধার্য করার পর থেকেই দেশজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়; নাশকতা, গাড়িতে আগুন, লকডাউন ঘোষণা এবং পাল্টা কর্মসূচিতে পরিস্থিতি আরও টানটান হয়। ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা।

মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় এবং দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত অডিও–ভিডিওসহ বিভিন্ন প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সাবেক আইজিপি মামুন নিজের অপরাধ স্বীকার করে বিস্তারিত বর্ণনা দেন, যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আনীত পাঁচটি অভিযোগ

১. উসকানিমূলক বক্তব্যে হত্যার প্ররোচনা

শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের বাচ্চা’ মন্তব্যের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হামলায় ১৫০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫ হাজারকে আহত করে।

মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা, যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি বাস্তবায়ন করেন। একাধিক অডিও এ নির্দেশের প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। রংপুরের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা গুলি করে হত্যা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন, তথ্য গোপন ও পাল্টা মামলা—সবই তিন আসামির নির্দেশে করা হয়েছে বলে আদালতের অভিমত। চানখাঁরপুলে আনাসসহ ছয়জনকে হত্যা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাওয়া ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা—যার নির্দেশদাতা হিসেবে তিন আসামিকে দায়ী করা হয়। আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানো হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে প্রমাণ নষ্ট করার নির্দেশও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে ছিল।

সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিচারিক প্রক্রিয়া

৩ আগস্ট থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়। পুরো বিচার কার্যক্রম বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। সাক্ষ্যগুলোতে সরাসরি উঠে আসে—জুলাই আন্দোলনে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারাত্মক নৃশংসতা, নিহতদের পরিবারদের কান্না এবং আহতদের করুণ অভিজ্ঞতা।

উভয় পক্ষের যুক্তি

প্রসিকিউশন: শেখ হাসিনাকে ‘নিউক্লিয়াস বা প্রভাবশালী নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করে তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। প্রসিকিউশনের বক্তব্যে উঠে আসে—একজন মানুষকে ১,৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড দেয়া না গেলেও, সর্বোচ্চ দণ্ডই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। ডিফেন্স: রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, “সরকার পরিচালনায় কিছু ভুল হতে পারে, কিন্তু এসব অভিযোগ প্রমাণিত নয়।” তিনি আসামিদের খালাস প্রার্থনা করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল: তিনি বলেন, “ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশ ভীরু জাতি হিসেবে বিবেচিত হবে।”

ট্রাইব্যুনালের পুনর্গঠন ও তদন্ত

২০২৪ সালের সরকার পরিবর্তনের পর পূর্বের বিচারককে বদলি করে নতুন করে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলের নেতা, পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট ৫৬টি অভিযোগ জমা পড়ে—যার ৫৪টিতেই প্রধান আসামি শেখ হাসিনা।

গ্রেপ্তার এড়াতে না পারে—এ কারণে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।

Facebook Comments Box
Share: