সমবায়ের সাফল্যের ঢেউ সারাদেশে, কিন্তু বঞ্চিত সিলেট বিভাগ!

তিমির বণিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: দেশজুড়ে সমবায়ের উন্নয়নযাত্রা জোরদার হলেও সিলেট বিভাগ যেন রয়ে গেছে সেই অগ্রযাত্রার বাইরে। “সাম্য ও সমতায়, দেশ গড়বে সমবায়”—এই প্রতিপাদ্যে আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় সমবায় দিবস। রাজধানী থেকে রাজশাহী পর্যন্ত সরকারের নতুন প্রকল্পে গ্রামীণ উন্নয়নের জোয়ার বইছে, অথচ সিলেট এখনো সেই উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত।

দেশের ৮ বিভাগের ৩৭টি জেলার ৫৬টি উপজেলায় “দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণ প্রকল্প” বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুধ উৎপাদনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন; সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা। কিন্তু সিলেট বিভাগের মাত্র তিনটি উপজেলায়— হবিগঞ্জের মাধবপুর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়—এই প্রকল্প সীমাবদ্ধ। এতে প্রশ্ন উঠেছে, বারবার কেন বঞ্চিত হচ্ছে সিলেট?

১৩৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের খামারিরা পেয়েছেন গাভী, প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণ সুবিধা। কিন্তু সিলেটের বেশিরভাগ খামারি এখনো নিজস্ব খরচে গরু পালন করে লোকসানের মুখে পড়ছেন। ফরিদপুরের ফিরোজা বেগম আজ সফল উদ্যোক্তা, অথচ সিলেটের শম্পা বেগম বাধ্য হচ্ছেন গরু বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে। স্থানীয়দের অভিযোগ, “সরকারি সুবিধা কাগজে আছে, বাস্তবে নেই সিলেটের জন্য।”

সমবায় অধিদপ্তরের “সমবায় মডেল গ্রাম” ও “দুগ্ধ সমবায় সম্প্রসারণ”সহ নানা প্রকল্প দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস্তবায়িত হলেও সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের অধিকাংশ উপজেলায় এর কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায়নি। অনেকের মতে, সরকারের চোখে সিলেট উন্নত অঞ্চল হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

স্থানীয় সমবায় নেতাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ প্রথমেই দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে চলে যায়, অথচ সিলেটের প্রস্তাবগুলো মাসের পর মাস পড়ে থাকে মন্ত্রণালয়ের টেবিলে। ঘন ঘন কর্মকর্তা বদলি, প্রশাসনিক জটিলতা ও অনিয়মের কারণে অনেক প্রকল্প অনুমোদনের আগেই থেমে যায়।

দেশের অন্যান্য বিভাগে মিল্ক ভিটার চিলিং প্ল্যান্ট থাকলেও সিলেটে নেই একটি পর্যন্ত—যা উন্নয়ন বৈষম্যের স্পষ্ট উদাহরণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সার্বিক উন্নয়ন সমবায়ের মাধ্যমে সফল করতে হলে সিলেট বিভাগকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির এক সাবেক পরিচালক বলেন, “যে অঞ্চল প্রবাসী আয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে, সেই অঞ্চলে কৃষি ও সমবায় উন্নয়ন না হওয়া নীতিগত ব্যর্থতা।”

এদিকে সিলেটের খামারিরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তাঁদের প্রশ্ন—“সরকার কি ইচ্ছাকৃতভাবে সিলেটকে উন্নয়নচক্রের বাইরে রাখছে?”

জাতীয় সমবায় দিবসের এ দিনে যখন সারাদেশে উন্নয়নের আলো ছড়াচ্ছে, তখন সিলেটবাসী সেই আলোর বাইরে। অনেকের ভাষায়, “সমবায়ের স্লোগান সাম্য ও সমতা, কিন্তু সিলেটের ক্ষেত্রে তা কেবল মুখের বুলি।”

সিলেটবাসীর প্রত্যাশা— সরকার যেন দ্রুত সিলেট বিভাগের জন্য নতুন সমবায় প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষক, মৎস্যজীবী, চা শ্রমিক ও পাথরশ্রমিকসহ সব শ্রেণির মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে। হাওর, চা-বাগান ও পর্যটন নির্ভর সিলেটে সমবায়ের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।

সিলেট কেবল প্রবাসী আয়ের কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক। তাই সমবায়ের অগ্রযাত্রায় সিলেটের অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি। সিলেটবাসীর আহ্বান—
“সাম্য ও সমতায় দেশ গড়বে সমবায়, সেই সমতায় সিলেটের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক এখনই।”

Facebook Comments Box
Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *