এনামুল হক রাশেদী, চট্টগ্রামঃ বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ ইউরোপীয় বিনিয়োগ; ‘সবুজ ও স্মার্ট’ বন্দর গড়ে উঠবে লালদিয়ায়
চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিক লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য ডেনমার্কভিত্তিক মায়ের্সক গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস বিভি’র সঙ্গে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “আজ অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চুক্তির বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে।”
পিপিপি ভিত্তিক বাস্তবায়ন, কমবে সরকারের ব্যয়
চুক্তির আওতায় প্রকল্পটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হবে। এর অধীনে এপিএম টার্মিনালস টার্মিনালটির ডিজাইন, অর্থায়ন, নির্মাণ ও পরিচালনা করবে; তবে মালিকানা থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে। এতে সরকারের মূলধনী ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে জানিয়েছেন বিডা চেয়ারম্যান।
বিশ্বমানের অভিজ্ঞ অপারেটর
এপিএম টার্মিনালস বিশ্বের ৩৩টি দেশে ৬০টিরও বেশি টার্মিনাল পরিচালনা করছে এবং শীর্ষ ২০টি বন্দরের মধ্যে ১০টির অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। ইউরোপ ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আশিক চৌধুরী বলেন, “এই প্রকল্প বাংলাদেশের বন্দর খাতে বিশ্বমানের প্রযুক্তি, দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে আসবে।” চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিডা ও অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশের প্রথম সবুজ ও স্মার্ট বন্দরঃ
লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল হবে বাংলাদেশের প্রথম সবুজ ও স্মার্ট বন্দর, যা বর্তমান সক্ষমতার দ্বিগুণ আকারের জাহাজ ধারণ করতে পারবে। টার্মিনালটিতে থাকবে ২৪ ঘণ্টা রাতের নেভিগেশন সুবিধা, সরাসরি বৈশ্বিক শিপিং সংযোগ এবং রপ্তানি-আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর সুযোগ।
৮০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগঃ
চুক্তি অনুযায়ী, এপিএম টার্মিনালস পুরো মেয়াদকালে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯ হাজার কোটি) বিনিয়োগ করবে—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ইউরোপীয় ইক্যুইটি বিনিয়োগ।
এলসিটি চালু হলে বন্দরটির বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৮ লক্ষাধিক টিইইউ (প্রমিত একক) বৃদ্ধি পাবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। টার্মিনালটি ২০৩০ সালের মধ্যে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজস্ব ভাগাভাগি ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্তঃ
প্রকল্পটি রাজস্ব ভাগাভাগি ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, যা সরকারের আয় বাড়াবে। নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে ৫০০ থেকে ৭০০ জনের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এছাড়া ট্রাকিং, স্টোরেজ, লজিস্টিকস ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে কয়েক হাজার পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও পরিবেশে বিশ্বমানঃ
এপিএম টার্মিনালস আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও পরিবেশ (HSSE) নীতি প্রয়োগ করবে। ডিজিটাল টার্মিনাল পরিচালনা ব্যবস্থা, লিন ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি ও ফ্লো প্রসেস ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করা হবে, যা স্থানীয় প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের দক্ষতা বাড়াবে।
রপ্তানিতে গতি, কার্বন নিঃসরণে হ্রাসঃ
দ্রুত জাহাজ টার্নঅ্যারাউন্ড সময় ও কম কনটেইনার ডওয়েল টাইমের মাধ্যমে রপ্তানিকারকরা—বিশেষ করে পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশল খাতের উদ্যোক্তারা—সময়সীমার মধ্যে সরবরাহ দিতে সক্ষম হবেন।
প্রকল্পের ফলে নতুন ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (ICD), কোল্ড চেইন ও শিল্পাঞ্চল সম্প্রসারণ ঘটবে। পাশাপাশি জ্বালানি দক্ষ প্রযুক্তি ও জলবায়ু অভিযোজন উদ্যোগের মাধ্যমে কার্বন নির্গমন হ্রাস পাবে, যা বাংলাদেশের প্যারিস চুক্তি (NDC) অর্জনে সহায়ক হবে।
বন্দর খাতে নতুন যুগের সূচনাঃ
বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পটি বাংলাদেশের বন্দর খাতকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাবে। এটি কেবল অবকাঠামো বিনিয়োগ নয়, বরং দেশের লজিস্টিক খাতকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে। রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক বিনিয়োগে এটি নতুন যুগের সূচনা করবে।”
