প্রতিবন্ধী মনার অদম্য লড়াই: শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে ঝুঁকিতে ভবিষ্যৎ

তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
জন্মের পর থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে আসছেন মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার রত্না চা–বাগানের তরুণী মনা (১৮)। বাঁ হাত, বাঁ পা ও কোমরে শক্তি না থাকায় তিনি দাঁড়াতে পারেন না—হামাগুড়ি দিয়েই চলতে হয় তাকে। ডান হাত ও ডান পায়ের জোরেই জীবনের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করেছেন এই দৃঢ়চেতা তরুণী।

অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি এবার এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই এখন শুরু—স্নাতকে ভর্তি হওয়ার খরচ জোগাড় করা।

প্রতিদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে বাসে উঠতেন মনা। এভাবেই তিনি নিয়মিত স্কুল ও কলেজে যাতায়াত করতেন। পথের কষ্ট, মানুষের কটূক্তি—কিছুই তাকে থামাতে পারেনি।

মনার বাবা হারিছ মিয়া রত্না চা–বাগানের দিনমজুর, মা আমিনা বেগম গৃহিণী। পাঁচ ভাই–বোনের মধ্যে মনা তৃতীয়। বড় ভাই আলাদা সংসারে, বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সংসারের সব দায়িত্ব এখন বাবা–মা ও ছোট ভাই–বোনের ওপর। পরিবারের দৈনিক আয় এতই সীমিত যে নিজের ওষুধের খরচ মেটাতেই কষ্ট হয়—উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব।

২০২৩ সালে স্থানীয় সাগরনাল উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ ২.৫৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেন মনা। এরপর শাহ নিমাত্রা সাগরনাল–ফুলতলা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়ও একই ফলাফল অর্জন করেন। পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হওয়ায় ফল আরও ভালো হতে পারত বলে মনে করেন তিনি।

মনা বলেন, “স্বাভাবিক মানুষের মতো চলতে পারি না। হামাগুড়ি দিয়ে যেতে দেখে অনেকে হাসাহাসি করে, কেউ আবার ভিডিও করে টিকটকে দেয়—খুব কষ্ট হয়। কিন্তু অনেকেই সাহস দেয়, পাশে থাকে—তাই মনোবল হারাই না।”

তিনি আরও বলেন, “লেখাপড়ার ফাঁকে এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়াই। কেউ টাকা দেয় না, তবু আনন্দ পাই। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু মা–বাবা আর পড়াতে চান না, টাকার অভাবে।”

মনার মা আমিনা বেগম বলেন, “মেয়েটা একটু গেলেই হাঁপিয়ে পড়ে। চিকিৎসা আর লেখাপড়ার খরচ দুইটাই বহন করা সম্ভব না। সরকারি ভাতা পাই, কিন্তু তিন মাস পর পর মাত্র আড়াই হাজার টাকার মতো আসে।”

শাহ নিমাত্রা কলেজের অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন বলেন, “মনা খুব সাহসী মেয়ে। প্রতিবন্ধকতা তার মনোবল ভাঙতে পারেনি। কলেজের পক্ষ থেকে আমরা টিউশন ফি, বই–খাতার খরচ দিতাম। স্নাতক পর্যায়েও একই সহযোগিতা অব্যাহত রাখব। এছাড়া ওর যাতায়াতের সুবিধার জন্য বৈদ্যুতিক তিন চাকার সাইকেল দেওয়ার উদ্যোগ চলছে।”

এলাকার সমাজকর্মীরা মনে করেন, মনার মতো প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের পাশে সমাজকেও দাঁড়াতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজসেবকরা যদি উদ্যোগ নেন, তবে এমন তরুণ–তরুণীরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পারবে।

এখন মনার একটাই অপেক্ষা—কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়ায়, তাহলে হয়তো তাঁর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আবারও ডানা মেলবে।

Facebook Comments Box
Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *