আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করবে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের লাখ লাখ সমর্থক। দলটিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত রাখার সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে এমন কথা জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বুধবার (২৯ অক্টোবর) নয়াদিল্লিতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি এ কথা বলেন।
অন্যদিকে, বার্তা সংস্থা এএফপিকে শেখ হাসিনা বলেন, জনতার ওপর গুলি চালানোর জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলাম—এই অভিযোগটি ভিত্তিহীন। যদিও তিনি স্বীকার করেন যে চেইন অব কমান্ডের মধ্যে কিছু ভুল অবশ্যই হয়েছিল।
তবে সামগ্রিকভাবে, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন তা ছিল আনুপাতিক এবং সদিচ্ছার সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রাণহানি কমানো।
গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের এমন প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, আমি নিহত প্রতিটি শিশু, ভাইবোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক জানাই। কিন্তু এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তার দাবি, সরকার উৎখাতের জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অস্থিরতা তৈরি করে চক্রান্ত করেছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, নিহতদের জন্য আমি শোক জানাই। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশকে গুলি চালাতে বলেছিলাম—এই মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করি।
৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনা রয়টার্সকে বলেছেন, তার দলকে বাদ দিয়ে যে কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তিনি আর বাংলাদেশে ফিরবেন না এবং তিনি ভারতে থাকার পরিকল্পনা করছেন।
ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছে এবং তারা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ক্ষমতায় একটানা ১৫ বছর থাকার পর নাটকীয় পতনের পর এই প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে রয়টার্সকে ইমেলের মাধ্যমে দেওয়া জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অন্যায্য নয়, এটি নিজেদের পরাজয়।
শেখ হাসিনা বলেন, পরবর্তী সরকারের নির্বাচনি বৈধতা থাকতে হবে। লাখ লাখ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ভোট দেবে না। একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইলে আপনি লাখ লাখ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।
আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়ার আশা
বাংলাদেশে ১২ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত ভোটার রয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে এবং আসন্ন ভোটে বিএনপির জয়ী হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
গত মে মাসে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। এর আগে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্তের কারণ দেখিয়ে দলটির সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্য কোনো দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া হবে।
শেখ হাসিনা বা তার পক্ষে অন্য কেউ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো গোপন আলোচনা করছেন কিনা, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
ড. ইউনূসের মুখপাত্ররা এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া দেননি।
বাংলাদেশি অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রশংসিত হলেও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমনের অভিযোগে অভিযুক্ত হাসিনা ২০২৪ সালে টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হন। সেই নির্বাচন প্রধান বিরোধী দল বর্জন করেছিল, যাদের শীর্ষ নেতারা হয় কারাগারে ছিলেন অথবা নির্বাসনে।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া শেষ করেছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র বিক্ষোভের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে বিক্ষোভ চলাকালীন প্রায় ১,৪০০ জন নিহত এবং আরও কয়েক হাজার আহত হয়েছে এবং এদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটি ছিল বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা।
এছাড়াও প্রসিকিউটররা অভিযোগ করেছেন যে, শেখ হাসিনা নিরাপত্তা সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত গোপন আটক কেন্দ্রে বিরোধী কর্মীদের গুম এবং নির্যাতনের তদারকি করেছেন।
তবে শেখ হাসিনা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি মারাত্মক শক্তি প্রয়োগ বা অন্যান্য কথিত অপরাধের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন না।
শেখ হাসিনা বলেন, এই প্রক্রিয়াগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রহসন। এগুলো ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ (অনৈতিক বিচারালয়) মাধ্যমে আনা হয়েছে, যেখানে দোষী সাব্যস্ত হওয়া অনিবার্য। আমাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পূর্ব নোটিশ দেওয়া হয়নি বা নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
আপাতত দেশে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই
রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রাজনীতিতে একটি ভূমিকা পালন করতে ফিরে আসবে – সেটা সরকারেই হোক বা বিরোধী দলেই হোক – এবং তার পরিবারের যে এটির নেতৃত্ব দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ, যিনি ওয়াশিংটনে থাকেন, গত বছর রয়টার্সকে বলেছিলেন যে, তাকে অনুরোধ করা হলে তিনি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এটা আসলে আমার বা আমার পরিবারের ব্যাপার নয়। আমরা সবাই বাংলাদেশের জন্য যে ভবিষ্যৎ চাই, তা অর্জনের জন্য সাংবিধানিক শাসন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফিরে আসতে হবে। কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবার আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না।
শেখ হাসিনা, তার বাবা এবং তিন ভাই ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন। সে সময় তিনি এবং তার বোন বিদেশে ছিলেন। তিনি বলেন যে, তিনি দিল্লিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করছেন তবে তার পরিবারের হিংসাত্মক ইতিহাসের কারণে সতর্ক থাকেন।
কয়েক মাস আগে, রয়টার্সের একজন সাংবাদিক দিল্লিতে ঐতিহাসিক লোধি গার্ডেনের মধ্য দিয়ে হাসিনাকে নীরবে হাঁটতে দেখেছিলেন, তার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মী বলে মনে হওয়া দুজন ব্যক্তিও ছিলেন। কিছু পথচারী তাকে চিনতে পারায় তিনি মাথা নেড়ে তাদের অভিবাদন জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি অবশ্যই বাড়ি ফিরতে চাই, যদি সেখানকার সরকার বৈধ হয়, সংবিধান সমুন্নত থাকে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে বজায় থাকে।
শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের কর্মীদের লক্ষ্য করে সহিংসতা শুরু হয়েছিল, যদিও তারপর থেকে রাস্তাঘাট মূলত শান্ত রয়েছে। তবে, রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য একটি সনদে স্বাক্ষরের সময় এ মাসের শুরুর দিকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল।
