March 28, 2024, 9:04 pm

করোনা ভাইরাস পরীক্ষায় অনিয়ম: বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতার আশংকা বাংলাদেশ

  • Last update: Saturday, July 11, 2020

বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে বাংলাদেশি যাত্রীদের শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের জন্য আকাশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে তিনটি দেশ বাংলাদেশি যাত্রীদের ওই সব দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ওপর আরো নিষেধাজ্ঞর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই কারণে দেশে এসে আটকা পড়া লক্ষাধিক মানুষ চার-পাঁচ গুণ বেশি দামে টিকিট কিনলেও সময়মতো গন্তব্যে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয় লোকবল, সরঞ্জাম ও সক্ষমতার অভাবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুধু তাপমাত্রা পরীক্ষা করে করোনা রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না। করোনায় আক্রান্ত যাত্রীদের বিমানবন্দরে এভাবে পার পেয়ে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভবিষ্যতে এ কারণে বিমান চলাচলে আরো নিষেধাজ্ঞা আসার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাওয়ার পর পজিটিভ হওয়ার ঘটনায় এসব সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই গত ১৬ জুন থেকে সীমিত পরিসরে কাতার এয়ারওয়েজ ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। এরপর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লন্ডন রুটে ফ্লাইট চালানো শুরু করে।

ইতালিতে গত মার্চে করোনাভাইরাসের প্রকোপ উচ্চ পর্যায়ে থাকার সময় সেখান থেকে অনেক বাংলাদেশি ফেরত এসেছিলেন। অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইতালির নাগরিক বা রেসিডেন্ট পারমিটধারী ইউরোপের দেশটিতে ফেরত যাচ্ছেন। কিন্তু বিমানবন্দরে তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন। গত বুধবার ইতালির রোমের ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে অবতরণকারী কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানের ১৫১ বাংলাদেশি যাত্রীকে ফেরত পাঠিয়েছে ইতালির সরকার। এর আগে গত সোমবার ঢাকা থেকে রোম যাওয়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ ফ্লাইটের ২১ যাত্রী করোনাভাইরাস পরীক্ষায় জিটিভ শনাক্ত হন। এর পরই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া যাত্রীদের ইতালি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এর আগে যাওয়া আরেকটি বিশেষ ফ্লাইটেরও ১৮ যাত্রী পজিটিভ শনাক্ত হন। দেশটি আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট ও যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শুধু বাংলাদেশি নয়, কোনো বিদেশি নাগরিকও বাংলাদেশ থেকে ইতালি ঢুকতে পারবে না। সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এ কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ থেকে ইতালি রুটে যাত্রী পরিবহনকারী কাতার এয়ারওয়েজ। তারা আর বাংলাদেশ থেকে ইতালিগামী যাত্রী নেবে না বলে জানিয়েছে। এর আগে গত মাসে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে যাওয়া অর্ধশতাধিক বাংলাদেশির শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। এরপর দেশ দুটি বাংলাদেশি যাত্রীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

ইতালির ঘটনার পর টার্কিশ এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে। এমিরেটস এয়ারলাইনসও ৭২ ঘণ্টা আগের করোনা সনদ ছাড়া যাত্রী বহন করবে না বলে জানিয়েছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নেওয়া কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বলে জানালেন এভিয়েশন বিশ্লেষক ও দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইতালি থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো আমাদের ভাবমূর্তির জন্য খুব খারাপ হলো। এ পরিস্থিতি সৃষ্টি আমরাই করেছি, এর সমাধানও আমাদের বের করতে হবে। এয়ারপোর্টে আমাদের সার্ভেইল্যান্স বাড়াতে হবে।’ তিনি বলছেন, কার করোনা আছে, কার নেই এটা দেখার জন্য বিমানবন্দরে কোনো নির্ধারিত ডেস্ক নেই। করোনা সনদ যদি রিজেন্ট হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠান দেয়, তাহলে তা জাল হবে-এটাই স্বাভাবিক। তাই তালিকাভুক্ত মানসম্মত সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা সনদ দেওয়ার দায়িত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে এয়ারপোর্টে সার্ভারে যারাই সার্টিফিকেট দেবে তা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘যেসব যাত্রী যাচ্ছে, তারা পজিটিভ না নেগেটিভ লক্ষণ নিয়ে যাচ্ছে এটা কাউকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আবার যারা তিন থেকে চার গুণ বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছে তারা এখন আদৌ বিদেশ যেতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার রিপোর্ট আসে না। আমরা শুধু জ্বরসহ কোনো লক্ষণ আছে কি না, এটুকুই থার্মাল স্ক্যানারে দেখছি। আমাদের আগত যাত্রীদের পরীক্ষায় যেভাবে কাজ করছি, সেভাবে বহির্গামী যাত্রীদের পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। এ জন্য কোনো ডেস্কও নেই।’ তিনি বলেন, ‘করোনা নেগেটিভ পেলেও সেই যাত্রী বাসা থেকে বের হয়ে গন্তব্যে যেতে গিয়ে কারো সংস্পর্শে এসে পজিটিভ হতে পারে।’

এমিরেটস এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ ছাড়া কোনো যাত্রীকে ফ্লাইটে ওঠানো যাবে না। ওই যাত্রী সুস্থ থাকলেও এ সনদ লাগবে। আর করোনা নেগেটিভ সনদ অবশ্যই ভ্রমণের ৭২ ঘণ্টা আগের হতে হবে। এর বেশি আগের সনদ গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ছাড়া কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ অবশ্য সরকার স্বীকৃত কোনো ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান কিংবা হাসপাতাল থেকে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণ কোনো হাসপাতালের সনদ গ্রহণযোগ্য হবে না।

বাংলাদেশি এয়ারলাইনসগুলো এ ব্যাপারে কতটা সতর্ক, সেটা নিয়ে কথা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোকাব্বির হোসেনের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এয়ারলাইনস চলে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) ও সিভিল এভিয়েশন অথরিটির গাইডলাইন অনুযায়ী এবং যে গন্তব্যে যাবে তাদের যদি কোনো কমপ্লায়েন্স থাকে সেই অনুযায়ী। আমরা ইতালিতে এসব কমপ্লায়েন্স মেনে ফ্লাইট পরিচালনা করেছি। ইতালির হাইকমিশন প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে দিয়েছে, তাদের ডেপুটি হাইকমিশনার প্রতি ফ্লাইটে উপস্থিত থেকে প্রত্যেক যাত্রীর কাগজপত্র চেক করে দিয়েছেন। স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। যে যা-ই করুক, সব দোষ বিমানের হতে পারে না।’

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিমানযাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট করে টেস্টিং সেন্টার থাকলে এ সমস্যা কমে আসত। বিভিন্ন জায়গা থেকে যে টেস্ট করা হচ্ছে, টেস্টের পরও পজিটিভ আসতে পারে। রিজেন্ট হাসপাতালের মতো ভুয়া সার্টিফিকেট আমাদের বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, কভিড-১৯ নেগেটিভের বিভিন্ন হাসপাতাল যে সনদ দিচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশের নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার মান যদি ভালো না হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ বিপাকে পড়তে পারে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি মনসুর আহমেদ কালাম বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলো কঠোরভাবে করোনা নিয়ে সতর্ক না থাকলে আমরা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তেই থাকব। একজনের জন্য বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইতালিতে গিয়েও যাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে তারা থাকছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গন্তব্য সংকুচিত হবে।’ তিনি বলেন, টিকিট নিয়ে সংকট চলছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এক লাখ শ্রমিক এসেছিলেন, যাঁরা ফিরে যেতে পারছেন না। এ ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকা যেতে চায় এমন ১৮ হাজার মানুষ টিকিটের জন্য ঘুরছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১৫ হাজার যাত্রীও অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞার খড়্গ এলে আমরা মহাবিপদে পড়ব।’

বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মহিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো এয়ারপোর্ট বলেনি বাংলাদেশি যাত্রীদের করোনা সনদ নিয়ে যেতে হবে। তার পরও আমরা যাত্রীদের বলছি, আপনারা করোনা পরীক্ষা করে যাবেন এবং ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। কিন্তু আমাদের দেশে করোনা পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা তার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দু-তিনবার চিঠি দিয়েছি এ বিষয়ে।’ তিনি আরো বলেন, ‘জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কিছু নির্ধারিত হাসাপাতাল আছে। এমন ব্যবস্থা করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে নেওয়ার জন্য আমরা বলেছি। তারা এই লক্ষ্যে কাজ করছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।’

Drop your comments:

Please Share This Post in Your Social Media

আরও বাংলা এক্সপ্রেস সংবাদঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© 2023 | Bangla Express Media | All Rights Reserved
With ❤ by Tech Baksho LLC