তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: শীতের মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন শীত প্রধানদেশ থেকে উষ্ণতার খুঁজে প্রাণ রক্ষার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব বৃহৎ হাওর হাকালুকিকে প্রিয় নিরাপদ আবাস্থল হিসেবে বেছে নেয়ে পরিযায়ী পাখিরা। তবে, জীবন রক্ষা করতে এসে বিষটোপ খেয়ে অবাধে মরছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
হাকালুকি হাওর অবস্থিত দেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ৫টি উপজেলার অংশ নিয়ে ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে ছোট বড় ২৭৩ বিল ও ১০ নদী ও অসংখ্য খাল রয়েছে। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওড়কে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে। যদিও জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকার সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জলাভূমিগুলোকে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। তবুও সেসব এলাকায় পাখি হত্যা চলছে অবাধে। বিভিন্ন কৌশলে স্থানীয় শিকারিরা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে হত্যার নিষ্ঠুর ও কুৎসিত পথ বেছে নিয়েছেন বিষটোপ!
গত বুধবার মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওড়ের নাগুয়া ও চাতলার বিলে পাখি দেখতে ও ছবি তোলার জন্য আসেন ৪ জন আলেকচিত্রি তাঁরা হলেন সৈয়দ আব্দু, শাহানুল করিম চলপ, মো. রিজওয়ানুল করিম ও সুলতান আহমদ। তাঁরা একসময় উপস্তিত হোন নাগুয়া বিলের পাশে। হাঠাৎ, দেখেন নাগুয়া বিলের মোট ৩২ টি হাঁস পাখির মৃতদেহ। আশপাশে একটি দুটি করে ধুকে ধুকে মরছে আরো কয়েকটি পাখি। এগুলো বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি পিয়াং হাঁস ও উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে মৃত পাখি গুলো মাটিচাপা দেন তাঁরা।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, শিকারি তারা দল বেঁধে বিষটোপ ও জাল দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করছে। তারা সেসব পাখি গোপনে চড়া দামে বিক্রিও করছে। তবে, প্রভাবশালী শিকারিরা তাদের দলে থাকায় তাঁরা মুখ খুলে কাউকে এ বিষয়ে বলতে পারছে না। চাতলা বিলের ইজারাদার হাবিবুর রহমান বলেন, হাকালুকি হাওড়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। আগে আগে অনেক পাখি দেখতাম এবার এসব চোঁখে পড়ছে না।
পরিচয় গোপন রেখে বড়লেখা উপজেলার আজিমগঞ্জ বাজারের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি জানান, প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ জনের একটি পাখি শিকারি দল শিকার করে নিয়মিত। আমার কাছে পাইকারি পাখি বিক্রি করে। আমি এগুলো স্থানীয় বাজার ও বসতবাড়িতে বিক্রি করি। এটা কিছুটা লাভজনক। হাওড়ে পাখি কিনতে পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে স্থানীয় একজন বলেন, হাকালুকি হাওড়ের পাখির অনেক দাম ২টা হাঁস পাখি ১৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন। আপনার লাগলে অর্ডার দিতে পারেন। এখানে অনেকেই শিকার করে। তবে শর্ত হলো কেনার সময় একা আসতে হবে।
পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য খালিদুর রহমান বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২ অনুযায়ী যে কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, ক্রয়-বিক্রয় ও নিজের দখল বন্ধি করে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু, শীত মৌসুমে একটি কুচক্রী মহল পাখি শিকারের মতো নিকৃষ্ট একটি কাজে লিপ্ত। আমরা মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি, তবুও এসব বন্ধ করতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের বেশিরভাগ দেশি প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ছাড়াও পরিযায়ী পাখির বিচরণভূমি হিসেবে দেশের অন্যতম জলাভূমি। আইনের প্রয়োগের অভাবের কারণে মূলত এটি ঘটে। পাখি বিক্রি কঠোরভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।
শীতে প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচতে নানান প্রজাতির পাখি আশ্রয় নেয় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমিতে। আইনে যদিও পরিযায়ী পাখি ধরা, আটকে রাখা ও হত্যা করা আইনত নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবুও স্থানীয় শিকারিরা হাওড়ের বিভিন্ন বিলে নিয়মিত বিষের ফাঁদ ফেলেন!
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ এর কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর, এপিডেমিওলজি ও সৌখিন বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক ডাঃ মোঃ রিজওয়ানুল করিম বলেন, হাকালুকি হাওড়ে আমরা মূলত পাখি দেখতে এবং ছবি তোলার জন্য আমরা ৪ জন গিয়েছিলাম নাগুয়া ও চাতলার বিলে। তখন আমরা নিজের চোখে এই নিষ্টুর বিষয় গুলো দেখে হতবম্ভ হয়ে যাই। মানুষ মাছ ধরার নামে রাত্রে বিভিন্ন ধরনের জাল ও বিষটোপ প্রয়োগ করে আর ভোরবেলা এসে বিষটোপ খেয়ে মরা এই পাখি গুলো ধরে জবাই করে বিভিন্ন যায়গায় বিক্রি করে থাকে। এসব পাখি খেয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয় এমনকি মৃত্যু ও হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই বিষক্রিয়ায় মৃত পাখিগুলো জবাই করে বিভিন্ন হোটেলে পাখির মাংস হিসাবে বিক্রয় করা হয়। ফলে একদিকে জীব বৈচিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এইসব বিষযুক্ত পাখির মাংস খেয়ে সাধারণ মানুষ স্নায়ু, কিডনী, লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে এমনকি ক্যান্সারের মত মরব্যাধী রোগের সম্ভাবনাও যথেষ্ঠ। বয়োবৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের বেলায় এই ঝুকি অনেকগুণ বেশী। এই পাখির মাংস খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি পরিযায়ী পাখি রক্ষায় বনবিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিয়মিত প্রশাসনিক মনিটরিং এবং আন্তরিক সহযোগিতা থাকতে হবে।
সিলেট বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রতিবেদকে বলেন, বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যার বিষয়টি আমার নজরে আসলে আমি জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা মিটিংয়ে এসব বিষয়ের সংশ্লিষ্ট প্রসাশনের সাথে কথা বলেছি। এই বিষটা মূলত কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সুযোগে কিনে শিকারিরা পাখি হত্যার কাজে ব্যবহার করে। আমরা অনুসন্ধান করে খুব দ্রুত এদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।